পাল্টে গেছে ১০ হাজার শিক্ষার্থীর জীবন, করুণ দশা শিক্ষকদের
তিন বছর ধরে এমপিওভুক্তির আশায় সরকারের দিকে চেয়ে রয়েছে গাইবান্ধার সাত উপজেলার ১১৬টি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়ের দুই সহস্রাধিক শিক্ষক-কর্মচারী। এসব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষকরা বিনা বেতনে পাঠদান করছেন।
দীর্ঘদিনেও বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। ফলে তারা হতাশ হয়ে পরেছেন। বর্তমানে এসব বিদ্যালয় ও প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য নেই সরকারি সহযোগিতা। কোনো বেতন-ভাতাদি না পেলেও বেশ আন্তরিকতার সঙ্গেই পাঠদান ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক-কর্মচারীরা।
সুইড বাংলাদেশ গাইবান্ধা জেলা শাখা সূত্রে জানা যায়, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের অধীনে গাইবান্ধার সাত উপজেলায় ২০১৫ সাল থেকে ১১৬টি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বেসরকারি সংস্থা সুইড বাংলাদেশ এসব বিদ্যালয় পরিচালনা করে থাকে। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন দুই হাজারের বেশি আর প্রতিবন্ধী শিশু ও ব্যক্তি লেখাপড়া করছে দশ হাজারেরও বেশি। বর্তমানে স্বেচ্ছাশ্রমে এসব প্রতিবন্ধীদের পাঠদান করাচ্ছেন শিক্ষকরা।
সরেজমিনে জানা গেছে, বিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক শিশু ও ব্যক্তিরা ভর্তি হওয়ার পর থেকে বদলে যাচ্ছে তাদের জীবন। আগে যারা স্পষ্ট করে কথা বলতে পারতো না, পারতো না লিখতে, চিনতো না বাংলা ও ইংরেজি বর্ণমালা, বুঝতো না পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। ঠিক তারাই এখন স্পষ্ট করে কথা বলতে পারে, লিখতে পারে, চেনে বর্ণমালা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়েও তারা এখন অনেক সচেতন। এ সবকিছুই সম্ভব হচ্ছে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের আন্তরিকতায়। এসব প্রতিবন্ধী শিশু ও ব্যক্তিদের যাতায়াতের জন্যও রয়েছে রিকসা-ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহন।
আর তাই এসব বিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধী শিশু ও ব্যক্তিদের সুদিন ফিরতে শুরু করেছে। এমতাবস্থায় এই ধারা অব্যাহত রাখতে হলে দ্রুত বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়গুলো এমপিওভুক্ত করতে হবে। তা না হলে এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরা অন্যপেশায় চলে যাবেন। বন্ধ হবে বিদ্যালয়গুলো। ফলে আবারও অবহেলা ও অসহযোগিতায় পিছিয়ে যাবে প্রতিবন্ধীরা। এসব বিদ্যালয়ের উন্নয়নে ইতোমধ্যে ১০ থেকে ২৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।
সাদুল্লাপুর উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের জয়দেব বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয় ২০১৫ সালে। বিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন ৪২ জন। আর প্রতিবন্ধী শিশু ও ব্যক্তি ভর্তি রয়েছেন ১৭৩ জন।
গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে সরেজমিনে বিদ্যালয়টিতে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে প্রতিবন্ধী শিশুদের পাঠদান করাচ্ছেন। ফিজিওথেরাপিস্ট গোলাম মোস্তফা এক শিশুর দাঁত ব্রাশ করে দিচ্ছেন।
অভিভাবক জোসনা বেগম বলেন, আমার মেয়েটা আগে কিছু বুঝতো না। এখন মানুষের সঙ্গে মেশে। কথা বলার চেষ্টা করে। বাবা-মা বলে ডাকে। ইশারার মাধ্যমে পায়খানা-প্রসাব করার কথা বোঝায়। দিন-দিন তার অনেক উন্নতি হচ্ছে।
সহকারী শিক্ষক শরিফুল ইসলাম বলেন, প্রতিবন্ধী শিশু ও ব্যক্তিদের কারিগরি ও কুটির শিল্পের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এতে করে তারা আত্মনির্ভরশীল হতে পারবে। বিদ্যালয়গুলোকে এমপিওভুক্ত করলে আরও যেমন সুযোগ-সুবিধা বাড়বে তেমনি উপকৃত হবে প্রতিবন্ধীদের পরিবারসহ শিক্ষক-কর্মচারীরা।
প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিবন্ধীদের জীবনপট পাল্টে উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। তারা এখন অনেক কাজে পারদর্শী হয়ে উঠছে। কিন্তু আমাদেরই কেবল কোনো উন্নতি হচ্ছে না।
বিদ্যালয় থেকে কেউ কোনো প্রকার বেতন ভাতাদি পাচ্ছি না। ফলে অনেক কষ্ট করে সংসার চালাতে হচ্ছে শিক্ষক-কর্মচারীদের।
অতিদ্রুত এসব বিদ্যালয় এমপিওভুক্তির আওতায় আনা জরুরি। তা না হলে বিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে যাবে। এমপিওভুক্তির জন্য আমরা সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
সদর উপজেলার বল্লমঝাড় ইউনিয়নের উত্তর ধানঘড়া এলাকায় সরকারপাড়া বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয় ২০১৫ সালে। এতে শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন ৪২ জন আর প্রতিবন্ধী শিশু ও ব্যক্তি ভর্তি রয়েছে ১৮৩ জন। প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষা উপকরণসহ ব্যয়াম করার জন্য বিভিন্ন উপকরণ রয়েছে। শিক্ষক-কর্মচারীদের আন্তরিকতায় এই বিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধী শিশুরাও এখন অনেক কাজে পারদর্শী হয়ে উঠেছে। রয়েছে ফিজিওথেরাপিস্টসহ সংগীত ও বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক।
প্রধান শিক্ষক জাহানারা আক্তার বলেন, বিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিবন্ধী শিশু ও ব্যক্তিদের অনেক উপকার হচ্ছে। আমরা সেবা দিয়ে যাচ্ছি কিন্তু কোনো আর্থিক সুবিধা পাচ্ছি না। বিদ্যালয়টিকে তাড়াতাড়ি এমপিওভুক্ত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।
বিদ্যালয়টির সভাপতি আব্দুর রশিদ বলেন, প্রতিবন্ধী শিশু ও ব্যক্তিদের উন্নয়নে তাদের চাহিদা মতো সকল প্রকার শিক্ষা ও ব্যয়ামের উপকরণ রয়েছে। জমি কেনা, অবকাঠামো তৈরিসহ বিভিন্ন খাতে ইতোমধ্যে এসব বিদ্যালয়ের পেছনে ১০ থেকে ২৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এতকিছু করার পরও বিদ্যালয়গুলোতে সরকারের কোনো সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না।
জেলা শহর সংলগ্ন সদর উপজেলার খোলাহাটি ইউনিয়নের নতুন ব্রিজ এলাকায় রহিম-আফতাব বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয় ২০১৬ সালে। এখানে শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছে ১৮ জন আর প্রতিবন্ধী শিশু ভর্তি রয়েছে ৭০ জন। এই বিদ্যালয়েও রয়েছে প্রতিবন্ধী শিশুদের ব্যয়ামসহ বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা উপকরণ এবং খেলার সরঞ্জামাদি।
বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক এস কে এ টি এম রওশন হাবীব বলেন, প্রতিবন্ধী এসব শিশুদের টিফিনে নাস্তা, অসচ্ছল শিশুদের যাতায়াতের টাকা, স্কুলের ব্যাগ ও পোশাক দিতে হয়। এবার তাদেরকে সোয়েটার ও কম্বল দেয়া হয়েছে।
সুইড বাংলাদেশ গাইবান্ধা জেলা শাখার সমন্বয়কারী ময়নুল ইসলাম রাজা জাগো নিউজকে বলেন, বিদ্যালয়গুলোর কারণে প্রতিবন্ধী শিশু, ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যদের অনেক উপকার হচ্ছে। বিদ্যালয়গুলো চালু রাখতে হলে খুব দ্রুত এমপিওভুক্ত করতে হবে।
এসব বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়ের মতো জেলায় আরও ১১৩টি বিদ্যালয়ের মাধ্যমে ১০ সহস্রাধীক প্রতিবন্ধী শিশু ও ব্যক্তির সুদিন ফিরছে। তাই তাড়াতাড়ি এসব বিদ্যালয়গুলো এমপিওভুক্তির আওতায় আনা প্রয়োজন।
রওশন আলম পাপুল/এমএএস/পিআর