দোকানিকে লেখা এসএম সুলতানের সেই চিঠি
বরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের প্রতি অন্য রকম ভালোবাসা প্রদর্শন করলেন এক সুলতান ভক্ত। তার নাম সারজান। তিনি নড়াইল শহরের বাসিন্দা।
এসএম সুলতানকে ভালোবেসে নিজের ফার্মেসির দোকানের সামনে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত এসএম সুলতানের প্রতিবেদন, ফিচার এবং তার কাছে সুলতানের লেখা কয়েকটি চিঠির ফটোকপি একটি ব্যানারে প্রদর্শন করেছেন।
শিল্পী সুলতানের ৯৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত সুলতান মেলা উপলক্ষে এ ব্যতিক্রমী প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন তিনি। মেলা প্রাঙ্গণ থেকে তার দোকানের দূরত্ব মাত্র কয়েকশ গজ।
চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানকে নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টের কাটিং দিয়ে এ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছেন তিনি। ২৬ ডিসেম্বর থেকে ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত নড়াইলের সুলতান মঞ্চে সুলতান মেলা শুরু হয়েছে। সুলতান ভক্ত সারজানের এ প্রদর্শনীও চলবে ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিল্পী সুলতান সারাজীবন কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে চলাফেরা করতেন। একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় সারজান বয়সে ছোট হলেও সুলতানের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। শিল্পী তার জীবদ্দশায় প্রায় প্রতিদিন সারজানের দোকানে এসে বসতেন এবং গল্প করতেন। সুলতানের যেকোনো অনুষ্ঠানের খবর পেলে সেখানে ছুটে যান সুলতান ভক্ত সারজান। নিজের দোকানেও শিল্পীর ছবির পাশে নিজের একটি ছবি বাঁধাই করে রেখেছেন তিনি।
যে সুলতান একদিন বিশ্বকে কাঁপিয়েছেন, দেশকে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, সেই বরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতান অনেক সময় অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে দিন কাটিয়েছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অভাব তাকে তাড়া করে ফিরেছে। সুলতান নিজের ও পরিবারের জন্য ওষুধ, প্রিয় শিশু ও পশু-পাখির জন্য, ঢাকায় যেতে, বাড়ির অতিথিদের জন্যসহ বিভিন্ন কারণে হাতেগোনা দু’একজনের কাছ থেকে টাকা ধার করেছেন। তাদের একজন হচ্ছেন নড়াইল শহরের এই সারজান।
শিল্পী সুলতান শহরের রূপগঞ্জ এলাকার তাহিদুল ইসলাম সারজানের মিতালি ফার্মেসির ওষুধের দোকানে প্রায় প্রতিদিনই বসতেন। অত্যন্ত আপন মানুষের মতো তার সঙ্গে লেন-দেন করতেন। অসুস্থতা বা কাজের কারণে অনেক সময় তিনি আসতে পারতেন না। শিল্পীর কাছে অর্থ না থাকলে তার কাছের মানুষ বলে পরিচিত বানছা বিশ্বাস বা ওসমান কখনও দুলাল সাহা বা রহমানকে বাজার করতে সারজানের কাছে একটি চিঠি লিখে বাজারের ব্যবস্থা করে দিতে বলতেন। সেসব চিঠির ভাষা আর পাঁচটি চিঠির ভাষার মতো নয়। শিল্পীর মৃত্যুর এতগুলো বছর পরেও তিনি এসব চিঠি যত্ন করে রেখে দিয়েছেন। শিল্পীর লেখা কয়েকটি চিঠিও প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে।
সুলতান একটি চিঠিতে লিখেছেন, ‘সারজান, পশু পাখিদের জন্য যন্ত্রণা আমার সহ্য হচ্ছে না। নিতান্ত অর্থাভাবে আছি। কোন রকম বাজার হচ্ছে না। কিছু ব্যবস্থা কর।’
সুলতানের মৃত্যুর কিছু দিন আগে ৯৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর লিখেছেন, ‘সারজান, বিষ্ণুকে পাঠালাম। অন্তত তিন শত টাকার সাহায্য করিও।’
একই সালের ১২ সেপ্টেম্বর লিখেছেন, ‘সারজান কিছু মনে কর না। এই অভাব একটু সুস্থ হলে আর থাকবে না। কারো কাছে বলা যায় না। চালিয়ে নিও।’
৯০ সালের ৩ এপ্রিল এক চিঠিতে লিখেছেন, ‘শূন্যহাত। বাজার খরচ নাই। দুলালকে (সুলতানের পালিত পুত্র) ঢাকা পাঠাইয়াছি। হয়ত শিল্পকলা একাডেমি থেকে এক মাসের টাকা পাওয়া যাবে। তিন দিন পর আসবে। তুমি অন্তত দুই শত টাকা ওসমানের (সুলতানের বাসার কেয়ারটেকার) মারফত সাহায্য করিও।’
অন্যের জন্য সাহায্য চেয়ে লিখেছেন, ‘সারজান, কুড়ি টাকা রহমানকে দিয়া দিবা। অন্যথায় ওর বাজার হবে না। ক’দিন তোমাকে বার বার বিরক্ত করছি। মনে কিছু করিও না।’
এরপর দিন অন্য এক চিঠিতে লিখেছেন, ‘সারজান, বানছা বিশ্বাস আমাদের বাড়িতে বছর ভরে কাজ করে। খুবই বিশ্বস্ত। ভালো মানুষ। ওর জন্য ৫০ টাকা প্রয়োজন।’
৯০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সুলতান লিখেছেন, ‘সারজান চাল কিনতে হবে। জীবজন্তুর দুপুরে রান্না হবে না। কালকের মত একটু কষ্ট করে একটা ব্যবস্থা করিও।’
একই বছরের ৩ অক্টোবর লিখেছেন, ‘সারজান, আজকের বাজারের কোন ব্যবস্থা হল না। একটু কষ্ট করে দ্যাখ দেখি সম্ভব হয় কিনা। অন্যথায় জীবজন্তু নিয়ে মুশকিল। ওদের জন্য কিছু করা যায় কিনা দ্যাখ।’
এ রকম শতাধিক চিঠি ৫/৬ বছর ধরে শিল্পী সুলতান তার প্রিয় সারজানের কাছে লিখেছেন। সাহায্যের এসব চিঠির জন্য সারজানের কখনও আপত্তি ছিল না বরং তিনি গর্ববোধ করেন। অনেক চিঠি হারিয়ে ফেললেও ৩০টির মতো চিঠি বাঁধিয়ে রেখেছেন তিনি।
তাহিদুল ইসলাম সারজান বলেন, ‘সুলতান কাকু আমাকে নিজ সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। মাঝে মধ্যেই তিনি টাকা ধার নিতেন। কিছু অর্থ পরিশোধ করেছেন। কিছু শোধ করতে পারেননি। সবচেয়ে বড় কথা হলো- একজন মহান ব্যক্তিকে সাহায্য করতে পেরে গর্ববোধ করি। তার প্রতি এ শ্রদ্ধাবোধ এবং ভালোবাসা থেকেই এ রিপোর্ট ও চিঠি প্রদর্শন করছি।
হাফিজুল নিলু/এএম/আইআই