অসুস্থ অবস্থায় শরীয়তপুর সদর হাসপাতাল
শরীয়তপুর জেলার প্রায় ১৬ লক্ষ মানুষের সুচিকিৎসার জন্য স্থাপিত শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে ভেঙে পড়েছে। এক যুগ পার হলেও জেলা হাসপাতালটি ১০০ শয্যার হয়েও বর্তমানে এখানকার কার্যক্রম চলছে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের চেয়ে কম জনবল দিয়ে। জনবলের অভাব থাকা সত্বেও হাসপাতালের ডাক্তার ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া ন্যূনতম সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। আর এসব ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালদের দৌরাত্মে রোগীরা এখন হয়ে পড়েছেন দিশেহারা। ফলে চিকিৎসা সেবা যেমন ব্যহত হচ্ছে, তেমনি রোগীদেরও নানা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
শরীয়তপুর সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ১৯৯০ সালে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০৩ সালে হাসপাতালটিকে ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। বর্তমানে হাসপাতালের ভৌত অবকাঠামো, রোগীদের পথ্য ও ওষুধ সামগ্রী ১০০ শয্যার হলেও হাসপাতালের জনবল পূর্বের ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের চেয়েও অনেক কম।
আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকা সত্বেও জনবল অভাবের দোহাই দিয়ে বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে দেন স্বয়ং ডাক্তার তার পছন্দের স্থানে। বেশিরভাগ সময় হাসপাতালে ডাক্তারের জন্য নির্ধারিত কক্ষটি থাকে তালাবদ্ধ অবস্থায়। রোগীরা এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে অনেক সময় চিকিৎসা না পেয়েই চলে যান। হাসপাতালে ডাক্তারের জন্য নির্ধারিত কক্ষে ডাক্তারের আশপাশে রোগী ছাড়াও অনেক লোক বসে থাকতে দেখা যায়। জানা গেছে, এ বসে থাকা লোকগুলো বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালাল। কমিশনের লোভে আর ডাক্তার নিজের প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার কথা বিবেচনা করে ওইসব দালালদের সহায়তায় গরীব রোগীদের তার নিজের ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে দেন এক গাদা পরীক্ষা দিয়ে।
সরেজমিনে সদর হাসপাতালে দুই দিন গিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতালে ডাক্তারের আউটডোরে ৮টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত থাকার কথা থাকলেও তাদের বেশিরভাগ ডাক্তারকে পাওয়া য়াযনি। খবর নিয়ে জানা যায়, তারা ওই সময় বিভিন্ন ক্লিনিকে সময় দিয়েছেন। হাসপাতালে নারী ডাক্তার থাকলেও তারা ব্যস্ত থাকেন বিভিন্ন ক্লিনিকের সিজারের কাজে। ফলে বহির্বিভাগের নারী রোগীদের এক রকম বাধ্য হয়েই শরণাপন্ন হতে হয় পুরুষ চিকিৎসকের। এছাড়া হাসপাতালে মেডিসিন কনসালটেন্ট, অর্থোপেডিক্স কনসালটেন্ট না থাকায় রোগীরা দায়সারা চিকিৎসা নিয়ে চলে যান।
১০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে যেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও মেডিকেল অফিসার মিলিয়ে ৪০ জন চিকিৎসকের পদ রয়েছে, সেখানে বর্তমানে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ১৩ জন। নার্স থাকার কথা ৫০ জন সেখানে রয়েছে ২৪ জন। জরুরি মেডিকেল অফিসার, রেডিওগ্রাফার, জুনিয়র মেকানিক, নিরাপত্তা প্রহরী ও মালির কোনো পদ নেই। ৩য় শ্রেণির কর্মকর্তা থাকার কথা ৩৮ জন, রয়েছে ১৫ জন। ৪র্থ শ্রেণি কর্মচারী থাকার কথা ৫৬ জনের, রয়েছে ২৩ জন। ৩টি অ্যাম্বুলেন্সই দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। বর্তমানে সদর হাসপাতালে কোনো অ্যাম্বুলেন্স নেই। তবে দুই জন অ্যাম্বুলেন্স চালক বেতন পাচ্ছেন। নেই কোন ব্লাড ব্যাংক।
হাত ভেঙে যাওয়ায় চিকিৎসা নিতে আসা মিরাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, হাসপাতাল হইল লোংরা (নোংরা), গোসলখানা ঠিক নাই, পায়খানা ঠিক নাই, সব লোংরা আর ডাক্তার আকরাম সারে তো এক সপ্তা (সপ্তাহ) হয় গেছেই গা হাসপাতালে নাই, জিগাইলে কয় কাইল আইবো পশ্যু-তশ্যু আইবো আহেই না। এমন কইরা ভারাইতাছে।
ডাক্তার দ্যাহাইছি কোন ওষুদ দেয় নাই। কয় ওষুদ হাসপাতালে নাই. আমনেরা বায়রার তোন কিন্যা লনগা। আমরা গরীব মানুষ আমরা কিনুম কী দিয়া আর কোনো টাকাও নাই আমাগো কাছে। সরকারি হাসপাতালে আহি তো ফ্রি ওষুদ পাওনের লিগ্যা আর হেইয়া যদি না পাই তয় আমরা কই যাইমু?- এভাবেই ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বললেন শিশু রোগীর অভিভাবক।
দুই রোগী আনোয়ারা বেগম ও সিদ্দিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমরা সরকারি হাসপাতালে আসি বিনামূল্যে চিকিৎসা নিতে কিন্তু ডাক্তারা একগাদা পরীক্ষা দেন আর বলনে, এই ক্লিনিকে যান ওই ক্লিনিকে যান বাইরে থেকে পরীক্ষা কইরা নিয়ে আসেন।
হাসপাতালে আসা মো. আবুল হোসেন ও হাসিনা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, মনে করেন আমরা যদি হাসপাতালে আইয়া ঠিকমতো ডাক্তার না পাই, তাদের চিকিৎসা না পাই, আমাদের আইয়া তো কোনো লাভ হয় না। আমরা কর্মজীবী মানুষ কর্ম ফালাইয়া আসি কতক্ষণ বইসা থাকুম? কিন্তু ক্লিনিকে গেলে হ্যাগো ঠিকই পাওয়া যায়। এটা আমাদের গরীবের একটা দুর্ভাগ্য!
সাধারণ জর নিয়ে চিকিৎসা নিতা আসা আবু বকর ও রাহেলা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ডাক্তার সুমন পোদ্দার হের পাশে থাকা একজন লোককে দিয়া স্লিপ ধরাইয়া হাজি শরীয়তুল্লাহ ক্লিনিকে (তিনি ওই ক্লিনিকের অংশীদারদের একজন) পাঠাইয়া দেন। পরীক্ষার লিগ্যা চার হাজার টাকা লাগবো। আমরা পাইমু কই? পরে আর একটা স্লিপ কাইটা এ হাসপাতালের আরেক জন ডাক্তার দেখাইলাম হে কইছে কাইলকো (আগামিকাল) হাসপাতালেই পরীক্ষা কইরা ওষুদ লিখ্যা দিব।
শরীয়তপুর জেলার সিভিল সার্জন মো. মশিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমি এখানে এপ্রিল মাসে দায়িত্বভার গ্রহণ করি। দায়িত্ব নেয়ার পর সদর হাসপাতালের যে বিচিত্র চেহারা দেখি তা আমার কাছে কষ্টদায়ক মনে হয়েছে। এখানকার জনবল, ব্যবস্থাপনা, রোগী সেবা দেয়ার পদ্ধতি আমাকে কষ্ট দিয়েছে। আমি জনগনের স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার লক্ষ্যে চেষ্টা করছি এবং আমার আপ্রাণ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
মো. ছগির হোসেন/এমজেড/পিআর