সেনা হস্তক্ষেপে বদলে গেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চিত্র
তিনদিন আগেও কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে উখিয়ার পর প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকায় রাস্তায় এলোমেলো বিচরণ ছিল হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-শিশু-পুরুষের। কোনো ত্রাণবাহী গাড়ি এলেই পেছনে ছোটা ও চারপাশে বাদুর ঝোলা দিয়ে কাড়াকাড়ি অস্থির করে তুলেছিল পরিস্থিতি।
সরকারের ব্যবস্থাপনায় সুপেয় পানির ব্যবস্থা থাকলেও নিজেদের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় কেউ পেয়েছে কেউ হয়েছে বঞ্চিত। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি অতীত। সুশৃঙ্খল ভাব ফিরে এসেছে সবখানেই।
রোহিঙ্গাদের সেই এলোমেলো বিচরণ আর নেই। নেই যত্রতত্র ত্রাণ বিতরণ আর সকাল-সন্ধ্যা রাস্তায় অপেক্ষার কোনো চিত্র। নিবন্ধনের জন্য এসে করতে হচ্ছে না অপেক্ষা। নির্বিঘ্ন হয়ে গেছে সড়কে যান চলাচল। লাঘব হয়েছে চিকিৎসা, স্যানিটেশন ও সুপেয় পানির।
প্রভাবশালী সুবিধাবাদি চক্রের সদস্যরা গা-ঢাকা দেয়ায় ক্যাম্পের সার্বিক পরিস্থিতির অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে বলে মনে করছেন আশ্রিত রোহিঙ্গা, এনজিও সংশ্লিষ্ট ও স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা। আর এসব সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে।
প্রত্যক্ষদর্শী এএইচ সেলিম উল্লাহ, শ.ম গফুর ও শহিদুল ইসলাম বলেন, গত শুক্রবার থেকে সেনা সদস্যরা উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান নিলেও মূলত তারা কার্যক্রম শুরু করেছে শনিবার থেকে। সেনা সদস্যরা ট্রাফিকের মতো যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে উখিয়া থেকে পালংখালী পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ কিলোমিটার সড়ক পথ নির্বিঘ্ন রয়েছে যানচলাচলে। অথচ এ সড়কে চারদিন আগেও রোহিঙ্গা এবং ত্রাণ বিতরণকারীদের গাড়ির কারণে জনচলাচলও দুরূহ হতো।
সড়কে চলাচলরত মাইক্রোবাসচালক শফিউল আলম বলেন, সেনাবাহিনী আরও আগে আসলে দীর্ঘ ২৫ দিনের ভোগান্তি পোহাতে হতো না।
সোমবার কুতুপালং, টিএনটি, টিভি রিলে কেন্দ্র, বালুখালী, থাইংখালীর ঢালা ও আনজুমানপাড়া আশ্রয় কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, কোনো ব্যাক্তি বা সংস্থার পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য নিয়ে আসা ত্রাণসামগ্রী সেনা সদস্যরা বুঝে নিয়ে প্যাকেটের সমসংখ্যক টোকেন ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে ত্রাণদাতাদের। তাদের বলে দেয়া হচ্ছে, আপনাদের পছন্দমতো আশ্রিতদের টোকেনগুলো বিতরণ করুন। টোকেন পাওয়াদের ত্রাণ নিশ্চিত করা হবে।
প্রত্যক্ষদর্শী ইউপি সদস্য মোজাফফর আহমদ সওদাগর বলেন, সেনাবাহিনীর উপস্থিতির ফলে দালালচক্র ভয়ে উধাও হয়ে গেছে। রোহিঙ্গারা যথাযতভাবে ত্রাণসামগ্রী পাচ্ছে।
বালুখালী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা নেতা আবু শামা, ছব্বির আলম বলেন, সেনা সদস্যরা দ্রুত নিবন্ধন সম্পন্ন করছে। আগে অনেক আশ্রিত নিবন্ধনকে গুরুত্ব না দিয়ে ত্রাণের পেছনে ছুটেছে। কিন্তু সেনা সদস্যরা নিবন্ধনের বাইরে থাকা রোহিঙ্গাদের সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ সুবিধা দিচ্ছে না এমন খবরে সবাই নিবন্ধন কার্যালয়ে মরিয়া হয়ে ছুটছে।
সোমবার বিকেলে নিবন্ধন অফিসে গিয়ে দেখা যায়, নিবন্ধন করার জন্য শতশত রোহিঙ্গা সুশৃঙ্খলভাবে আগ্রহসহকারে অপেক্ষা করছে। সেখানে কথা হয়, রেদোয়ান আলী নামের এক মাঝ বয়সী আশ্রিতের সঙ্গে। তিনি বলেন, এ পদ্ধতি আগেও ছিল। তবে হ-য-ব-র-ল অবস্থায় ছিল বলে কেউ গুরুত্ব দেয়নি। এখন এটি না করলে সহযোগিতা পাবার কোনো চান্স নেই। সেনাবাহিনীর দুরদর্শিতা আসলেই ভালো।
কুতুপালং ক্যাম্পে সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল মাহাবুব বলেন, ২-৩ মিনিটে একজনের নিবন্ধন সম্পন্ন হচ্ছে। রোববার পর্যন্ত ১৬ হাজার ২৬৪ জন রোহিঙ্গাকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়েছে। নিবন্ধন কার্যক্রম আরও গতিশীল করতে প্রয়োজনে বুথ সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে।
কৃতুপালং থেকে পালংখালী পর্যন্ত ঘুরে সড়কের আশেপাশে ত্রাণের জন্য অপেক্ষমান কোনো আশ্রিত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুর দেখা মেলেনি। স্থানীয়রা বলছেন, আগের মতো যত্রতত্র টাকা ও ত্রাণ দেয়া বন্ধ হওয়ায় কেউ আর রাস্তায় আসে না।
থাইংখালী হাইস্কুল মাঠে আশ্রয় নেয়া আয়েশা বিবি (৩৫) ও দিল ফরাজ খাতুন (৩৮) বলেন, সেনাবাহিনী আসাতে তারা দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পারছে। নিরাপদে রাতযাপন করতে পারছে। দালালচক্র আর ঘুরে না।
বালুখালী ক্যাম্পে দায়িত্বরত সেনা কর্মকর্তা মোসাদ্দেক আবু সায়িদ বলেন, রোহিঙ্গা ও স্থানীয়রা যার যার অবস্থানে স্বাচ্ছন্দে জীবনযাপন করতে পারে সেজন্য সার্বিক বিষয়ের উপর নজরদারি রাখছি।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, প্রতিদিন গড়ে শতাধিক ত্রাণবাহী ট্রাক রোহিঙ্গা শিবিরে পাঠানো হচ্ছে, যাতে কোনো রোহিঙ্গাকে অনাহারে থাকতে না হয়। সেনাবাহিনী এসব ত্রাণ টোকেনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের কাছে ধারাবাহিকভাবে বিতরণ করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক আরো বলেন, নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে প্রধানমন্ত্রীর সাহসি সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। এটি শেষপর্যন্ত যেন অটুট থাকে সেজন্য আমরা প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছি। সবাই এখন যেমন সহযোগিতা দিচ্ছে তেমনি আগামীতেও অব্যাহত রাখতে সবার প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
সায়ীদ আলমগীর/এমএএস/আইআই