চামড়ার ব্যবসা ছাড়তে হবে এবার
বাপ-দাদার পেশা চামড়ার ব্যবসা ছাড়তে হবে এবার। গতবার কোরবানির ঈদে ব্যবসা মোটামুটি বেশ ভালোই হয়েছে। কিন্তু এবার মাথায় হাত পড়েছে আমার। ১৭ হাজার টাকা সুদের ওপর নিয়ে ১৫টি গরুর চামড়া কিনেছিলাম। প্রতিমাসে ১ হাজার ৭০০ টাকা সুদ দিতে হবে। সকালেই হাটে এসেছি। হাটে আড়তদার আসছেন ঠিকই কিন্তু দাম বলছেন কম। এবার লবণের দামও অনেক। লবণ কিনে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে ব্যয় বেশি হয়েছে। ফলে এবার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হব।
কথাগুলো বলছিলেন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাখালবুরুজ ইউনিয়নের লগেন চন্দ্র রবিদাস (৩৫)। তিনি উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলা শহরের কালীবাড়ীর চামড়ার হাটে চামড়া বিক্রি করতে এসেছেন। এখানে প্রতি শনিবার ও বুধবার চামড়া বিক্রি হয়। এই হাটে রংপুর বিভাগের আট জেলাসহ পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো থেকেও চামড়া আসে প্রতিবছর। ফলে বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে ঐতিহ্যবাহী এই চামড়ার হাট।
বুধবার সকালে গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে ২১ কিলোমিটার দূরে পলাশবাড়ীর কালীবাড়ী চামড়ার হাটে গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকেই গাইবান্ধাসহ আশপাশের জেলাগুলো থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা পিকআপ ভ্যান, নছিমন ও রিকশা-ভ্যানে করে চামড়া নিয়ে আসছেন হাটে। এসব চামড়া গত শনিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত সংগ্রহ করেছেন খুচরা চামড়া বিক্রেতারা। কিছু কিছু আড়তদার চামড়ার দাম কষছেন। অন্যান্য বারের চেয়ে এবার হাটে আড়তদারের সংখ্যা খুবই কম।
খুচরা চামড়া বিক্রেতারা বলছেন, মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কারণে আমাদের বেশি দামে চামড়া কিনতে হয়েছে। এ ছাড়া লবণের দাম মাত্রাতিরিক্ত হওয়ার কারণে প্রত্যেকটি চামড়ায় খরচ অনেক বেশি পড়েছে। প্রতিবার চামড়ার হাটের আগের দিন ট্যানারি মালিক ও পাইকাররা আসতো। কিন্তু এবার ট্যানারি মালিক ও পাইকাররা আগে ভাগে আসেননি। তাই মৌসুমী আড়তদাররা চামড়ার কম দাম বলছেন।
অপরদিকে আড়তদাররা বলছেন, এবার প্রক্রিয়াজাতকরণ সঠিক না হওয়ায় অনেক চামড়ার গুণগতমান খারাপ হয়ে গেছে। পচে গেছে অনেক চামড়া। এরপরও চামড়ার দাম চাওয়া হচ্ছে অনেক বেশি। ফলে আমাদেরকে এবার বেশি দামেই কিনতে হচ্ছে চামড়া।
এবার সব ট্যানারি মালিকরা হাজারিবাগ থেকে কারখানা সাভারে স্থানান্তর করতে না পারায় অনেক ট্যানারি মালিক চামড়া কিনতে আসবেন না। ফলে চামড়া ক্রেতার সংখ্যা অনেক কম হবে এবার। তাই খুচরা ব্যবসায়ীরা কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত প্রায় দুই ঘন্টা এই হাটে অবস্থিান করে কোনো ট্যানারি মালিককে দেখতে পাওয়া যায়নি।
পলাশবাড়ী উপজেলার পবনাপুর ইউনিয়নের পবনাপুর গ্রামের হরিলাল চন্দ্র দাস (৫০) বলেন, যেখানে প্রতিবস্তা লবণের দাম ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা ছিল। এবার সেই বস্তা কিনতে হচ্ছে এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকায়। তাই চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের খরচ বেড়ে গেছে। গ্রামে গিয়ে দেখি মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীরা আগেভাগেই চামড়া কিনে রেখেছে। তাই এবার মাত্র আটটি গরু ও ২০টি ছাগলের চামড়া কিনেছি। প্রতিবার চামড়ার ব্যবসা করে সাত থেকে ১০ হাজার টাকা লাভ হতো। এবার লাভ তো দূরের কথা, আসল টাকাই উঠবে না।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নের ইন্দ্রাপাড় গ্রামের তারা চন্দ্র বিশ্বাস (৪৮) বলেন, এবার প্রতিটি গরুর চামড়া এক হাজার ২০০ টাকা থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা পর্যন্ত কিনতে হচ্ছে। এ ছাড়া লবণ, পরিবহন ও শ্রমিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় চামড়াপ্রতি আরও দাম বাড়ছে। কিন্তু আড়তদাররা দাম বলছেন খুবই কম। এ অবস্থায় প্রায় ছয় হাজার টাকা লোকসান হবে আমার।
বগুড়া থেকে চামড়া কিনতে আসা আড়তের মালিক আব্দুল জলিল (৩৭) বলেন, এবার চামড়ার দাম অনেক বেশি বলছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। ভালো চামড়ার দাম এক হাজার ৫০০ টাকা থেকে এক হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত হতো। গরমের কারণে অনেক চামড়ার মান কমে গেছে। এবার চামড়ার গুণগতমান ভালো না হলেও বেশি দাম চাচ্ছেন খুচরা চামড়া বিক্রেতারা।
পলাশবাড়ী চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আফতাব উদ্দিন মোল্লা বলেন, সঠিকভাবে চামড়া প্রক্রিয়াজাত না করার কারণেও অনেক সময় চামড়ার দাম কমে যায়। তাই যারা খুচরা চামড়া ব্যবসায়ী রয়েছে তাদেরকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। এ ছাড়া লবণের দাম বেশি, পরিবহন ব্যয় ও শ্রমিক খরচ বেশি হওয়ায় চামড়াপ্রতি খরচ বেড়ে যাচ্ছে খুচরা চামড়া ব্যবসায়ীদের।
রওশন আলম পাপুল/আরএআর/আরআইপি