৩০ একর জমির গাছ কেটে ৫০ হাজার রোহিঙ্গার বসতি
মিয়ানমারে দমন-পীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের রইক্ষ্যং এলাকায় পাহাড়ি ভূমি দখল করে অন্তত ৫০ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে শরণার্থী ক্যাম্প গড়ে তুলেছেন।
পাহাড় কেটে, বন-জঙ্গল উজাড় করে বাঁশ ও পলিথিন দিয়ে তৈরি করছে নতুন ঘরবাড়ি। নতুন শরণার্থী ক্যাম্প হওয়ার খবর পেয়ে রইক্ষ্যংয়ের দিকে ছুটে যায় হাজারও রোহিঙ্গা।
মঙ্গলবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রইক্ষ্যং অভিমুখে রোহিঙ্গাদের ঢল অব্যাহত ছিল। সেই সঙ্গে স্থল ও জল সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট পেরিয়ে রোহিঙ্গারা কুতুপালং, বালুখালী, টিঅ্যান্ডটি পাহাড় ও বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় ঝুপড়ি ঘর তৈরি করে আবাস গেড়েছেন।
গত তিন দিনে প্রায় কয়েক হাজার একর বন ভূমিতে নতুন রোহিঙ্গা বস্তি গড়ে উঠেছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা। সব পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের নতুন আবাস ছড়িয়ে পড়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সামাজিক বনায়নের উপকারভোগীরা।
তবে, নতুন আসা রোহিঙ্গাদের বালুখালীর বস্তিতে এনে এক জায়গায় রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন। মঙ্গলবার ঢাকায় রোহিঙ্গা সংক্রান্ত বিষয়ে করণীয় বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়ক থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার অভ্যন্তরে কাঁচা রাস্তা পার হয়ে যেতে হয় রইক্ষ্যং। পুরো এলাকাটাই সবুজ পাহাড়ে ঘেরা। পাশের সমতল ভূমিতে চাষ হতো নানা জাতের ফসল।
সরেজমিন দেখা যায়, রইক্ষ্যং যাওয়ার পথে হাজারো নারী-পুরুষের দীর্ঘ সারি। সবাই মিয়ানমারের নাগরিক। তারা বস্তা, কুড়াল, পলিথিন ও বাঁশ নিয়ে পাহাড়ের দিকে যাচ্ছে। অধিকাংশ নারীর কোলেই রয়েছে শিশু। এক রাতের ব্যবধানে কয়েকটি পাহাড় ন্যাড়া করে ফেলেছে রোহিঙ্গারা। সেখানে বনের গাছপালা উজাড় করে, পাহাড় কেটে সমতল করছে রোহিঙ্গারা।
এদিকে, গুলির মুখ থেকে পালিয়ে কোনোমতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তের জিরো পয়েন্টে এসে অনাহারে-অর্ধাহারে বিপর্যস্ত সময় কাটছে তাদের। আহত, গুলিবিদ্ধ, ক্ষুধার্ত, অসুস্থ, অর্ধবসনে, পলিথিনের ছাউনিতে রোদ-বৃষ্টিতে ছায়াহীন চরম বিপর্যয়কর পরিস্থিতি পার করছেন তারা।
এরপরও দলে দলে আসছে রোহিঙ্গা নারী-শিশু ও পুরুষ। মঙ্গলবার পর্যন্ত নতুন আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা পায় দুই লাখ ছুঁয়েছে বলে ধারণা করছেন ক্যাম্প এলাকার দায়িত্বশীলরা।
সোমবার সন্ধ্যার পর ও মঙ্গলবার দুপুরেও বাংলাদেশের উখিয়া-টেকনাফ সীমান্তের ওপারে বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক গ্রাম আগুনে জ্বলতে দেখা গেছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার সীমান্ত দিয়ে উড়ে যাওয়ার পরপর সোমবার সন্ধ্যায় বেশ কয়েকটি গ্রামে আগুন জ্বলে ওঠে।
মঙ্গলবার বেলা আড়াইটার দিকে তুমব্রু সীমান্ত এলাকার আকাশে উড়েছে মিয়ানমার সেনাদের আরেকটি হেলিকপ্টার। এটা কয়েক মিনিট আকাশে অবস্থানের পর চলে গেলে বিকেলের দিকে জ্বলে উঠে আগুন। আর এপার ও জিরো পয়েন্ট থেকে সেই আগুনের লেলিহান শিখায় নিজেদের সহায়-সম্বল ভস্মীভূত হওয়ার দৃশ্য অসহায় রোহিঙ্গারা নির্বাক চোখে দেখে নীরবে চোখের জল ফেলছিলেন।
সরেজমিন দেখা যায়, মিয়ানমারে চলমান সহিংসতার সপ্তাহের মাথায় ঈদের দিন রাত, আগের রাত ও পরের দিন রাতের আঁধারে হাজার হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে বাংলাদেশের ঘুমধুমের আমবাগান পয়েন্টে ও বালুখালীতে বনবিভাগের বিশাল এলাকাজুড়ে গেড়েছে নতুন বস্তি।
পুরোদমে চলছে ছোট-ছোট তাঁবু স্থাপনের কাজ। কয়েক সহস্রাধিক রোহিঙ্গা অবস্থান নিয়েছেন নতুন বস্তিতে। কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের থাইংখালী হয়ে বালুখালীর ছড়া পর্যন্ত চলছে বস্তি তৈরির কাজ। ওখানে অন্তত ১৫ হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু মাথা গোঁজার ঠাঁই করেছেন।
আবার কেউ মাটি কাটছেন, কেউ তাঁবু গেড়ে বস্তি দাঁড় করাচ্ছেন। আবার অনেকে সদ্য স্বজন হারানোর বিভীষিকাময় স্মৃতি মনে করে বিলাপে আহাজারি করছেন।
মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে চেষ্টা চালানো রোহিঙ্গারা প্রায় কয়েক হাজার একর বন ভূমিতে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা স্থাপনা করতে নির্বিচারে কাটছে সামাজিক বনায়নের গাছ। যে যেখান থেকে পারছেন গাছ কেটে ঘর বাঁধার কাজে লিপ্ত রয়েছেন।
বালুখালী টিঅ্যান্ডটি পাহাড় এলাকার সামাজিক বনায়ন উপকারভোগী নুরুল কবির ভূট্টো জানান, টিঅ্যান্ডটি পাহাড় এলাকায় ১০ হেক্টর সামাজিক বনায়ন রয়েছে। যেখানে গাছও বেশ বড় হয়েছিল। কিন্তু সদ্যাগত রোহিঙ্গারা তার অধিকাংশই দখল করে ফেলেছেন। কেটে ফেলছেন গাছ। এতে ভবিষ্যতে ভোগান্তিতে পড়তে হবে।
এসব কথার সত্যতা মিলেছে উখিয়ার থাইংখালী বনবিট কর্মকর্তা আবদুল মান্নানের কথায়। তিনি মঙ্গলবার বিকেলে জানিয়েছেন, বালুখালীতে ৮০ একর, তাজিনখোলায় ১০০ একর ও হাকিমপাড়া ৫০ একর সামাজিক বনায়নের বন ভূমিতে রোহিঙ্গারা নতুন করে ঘর তৈরি করছে। রোহিঙ্গাদের ঘর তৈরি প্রতিহত করতে অভিযান চালায় বনবিভাগ।
এ সময় রোহিঙ্গাদের সহায়তা করার অভিযোগে স্থানীয় পালংখালী এলাকার আবু জাফর (৪৫), শাহজাহান (৩৫), ছৈয়দুল আলম (৩২), জাহাঙ্গীর আলম (২৫), আবদুল করিম (২৮), ছৈয়দুল আমিন (৩২) ও মফিদুল আলমকে (৩৯) আটক করে উখিয়া থানায় সোপর্দ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এ ঘটনায় সামাজিক বনায়নের জমি দখলে অভিযোগে মামলা হয়েছে। এতে আরও ২১ জনকে পলাতক এবং অর্ধশত জনকে অজ্ঞাত দেখানো হয়।
সায়ীদ আলমগীর/এএম/এমএস