নওগাঁয় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, দুই লাখ মানুষ পানিবন্দি
‘বানের পানিতে বাড়িঘর ডুবে যাওয়ায় গত ৪দিন থেকে পলিথিন টাঙিয়ে সপরিবারে রাস্তায় আছি। এখানে পরিবারে ৬ জন সদস্যকে নিয়ে কষ্ট করে থাকা খাওয়া। এখানে রান্না ও গরু-ছাগল নিয়ে থাকা হচ্ছে। যা একটু খাবার ছিল এখন শেষের দিকে। সরকার থেকে এখানও কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাইনি।’
দুঃখ করে কথাগুলো বলছিলেন নওগাঁর মান্দা উপজেলার শামুকখোল গ্রামের বয়জ্যেষ্ঠ আইফা বেগম। শুধু আইফা বেগম না। এরকম রাস্তায় বসবাস করছেন একই গ্রামে ওসমান আলী, সেকেন্দার আলী, সুফিয়া বেগম, পশ্চিম নুরুল্লাহবাদ গ্রামের ফিরোজ হোসেন, হাফিজ উদ্দিনসহ কয়েকশ পরিবার। অনেকের বাড়িঘর বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ায় নৌকা ও কলাগাছের ভেলা করে বাড়ি থেকে তাদের মালপত্র রাস্তায় নিয়ে আসছেন।
নওগাঁয় বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হচ্ছে। উজান থেকে নেমে আসা এবং গত তিনদিন ধরে টানা বৃষ্টিতে আত্রাই নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ১৪টি স্থানে ভেঙে গেছে। এরমধ্যে মান্দায় ৬টি, রানীনগর ৫টি, আত্রাইয়ে ২টি ও পত্নীতলায় ১টি। বন্যার পানিতে জেলার রানীনগর, আত্রাই, মান্দা, পত্নীতলা, বদলগাছী ও ধামইরহাট উপজেলায় তলিয়ে গেছে প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি। এতে প্রায় দুই লাখ লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। মহাদেবপুর, আত্রাই, রানীনগর ও মান্দা উপজেলায় প্রায় ৯শ’ পুকুর ডুবে গেছে। এতে পুকুর থেকে প্রচুর মাছ বেরিয়ে গেছে। ফলে মাছচাষিদের কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে।
আত্রাই নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বিভিন্ন উপজেলায় নদীর বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের অন্তত ৪০টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এ দিকে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা শুরু হয়েছে। তবে প্রয়োজনীয় তুলনায় ত্রাণ খুবই অপ্রতুল বলে জানা গেছে।
এছাড়া ছোট যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নওগাঁ শহর রক্ষাবাঁধ উপচে এবং বাঁধের আউটলেট (নদী থেকে পানি বের করে দেয়ার নালা) নওগাঁ শহরের বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত।
নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, গত চারদিনে পাউবোর তীর সংরক্ষণ বাঁধের ১৪টি স্থান ভেঙে গেছে। বাঁধের রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় সোমবার সকাল থেকে জেলার আত্রাই উপজেলার সঙ্গে মান্দা এবং জেলা শহরের সঙ্গে আত্রাই উপজেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নওগাঁর ছোট যমুনা নদীতে পানি বিপদসীমার ৮৮ সেন্টিমিটার, ধামইরহাট উপজেলার শিমুলতলী আত্রাই নদী ১৭০ সেন্টিমিটার, মান্দায় আত্রাই নদী জোতবাজার ১১১ সেন্টিমিটার এবং আত্রাই উপজেলার আত্রাই নদীতে ৪৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বর্তমানে অসহায় পরিবারগুলো বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। বন্যার কারণে এলাকায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। নলকূপের গোড়া পর্যন্ত ডুবে থাকায় নলকূপ থেকে পানি উঠিয়ে খেতে হচ্ছে পানিবন্দিদের। এলাকা ডুবে থাকায় প্রসাব ও পায়খানার সমস্যার মধ্যে পড়েছে পানিবন্দিরা। এছাড়া গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সারাদিন গরু-ছাগলকে সামান্য পরিমাণ খড় ও গাছের লতাপাতা খেতে দেয়া হচ্ছে।
এদিকে ফসলের ক্ষেত ডুবে যাওয়ায় কৃষকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। জেলার ৫টি উপজেলায় প্রায় ৭০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পানি নেমে গেলে আবারও শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হবে। এছাড়া বন্যার কারণে কেউ যদি স্কুলে আশ্রয় নিতে চায় নিতে পারে এজন্য জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে স্কুল কর্তৃপক্ষকে অনুমোতি দেয়া আছে।
অপরদিকে, জেলা প্রশাসন থেকে ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হলেও এখনও অনেক জায়গায় বিতরণ শুরু হয়নি। তবে মান্দা উপজেলার পরানপুর ইউনিয়নে চেয়ারম্যান ইলিয়ান খান এক টন চাল বরাদ্দ পেয়ে মঙ্গলবার সকাল থেকে ১০ কেজি করে বিতরণ শুরু করেছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মনোজিত কুমার মল্লিক বলেন, জেলায় রোপা ও আমন ২৩ হাজার ৭০০ হেক্টর, আউশ ৫ হাজার এবং সবজি ৫০০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
নওগাঁ জেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এ কে এম আব্দুল মান্নান বলেন, প্রায় দুই লাখ লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। মহাদেবপুর, আত্রাই, রানীনগর ও মান্দা উপজেলার জন্য ৫২ হাজার টাকা ও ৩৩ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পানিবন্দি এলাকার তালিকা হাতে পেলে আগামীতে এর পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
আব্বাস আলী/বিএ