‘যশোরের দুঃখ’ হয়ে আবারও ফিরছে ভবদহ!

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি যশোর
প্রকাশিত: ০৬:১৯ এএম, ২৬ জুলাই ২০১৭

ভবদহ আবারও ‘যশোরের দুঃখ’ হয়ে ফিরে আসছে। ভবদহ সংলগ্ন যশোরের মণিরামপুর, কেশবপুর ও অভয়নগর অঞ্চলে আবারও স্থায়ী জলাবদ্ধতার পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন এলাকাবাসী।

টানা চারদিনের বর্ষণ আর উজানের নেমে যাওয়া পানিতে এ তিন উপজেলার ১২০ গ্রামের ১১ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। অতিবর্ষণের কারণে পানিবন্দি অবস্থা স্থায়ী রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।

তারা জানান, গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণে ভবদহ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত যশোরের অভয়নগর, মণিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলা বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। মাছের ঘের ভেসে গেছে। ফসলের মাঠ, বাড়িঘর প্লাবিত হয়ে মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছেন। ইতোমধ্যে জলাবদ্ধ এলাকায় কয়েকশ’ কোটি টাকার মাছ, ফসল, বাড়িঘর ও সড়কের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভবদহ অঞ্চলের নদী ও খালের পলি অপসারণে টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) চালু না হওয়ায় এবারও স্থায়ী জলাবদ্ধতায় আশংকা দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, কয়েকদিনের টানা বর্ষণে মণিরামপুর উপজেলার অন্তত নয় ইউনিয়নের প্রায় অর্ধশত গ্রামের প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। শ্যামকুড় ইউনিয়নের হাসাডাঙ্গা, আমিনপুর, নাগোরঘোপ, চিনাটোলা, শ্যামকুড়, জামলা, মুজগুন্নি, হালসা, ঘুঘুরাইল, আগরহাটি, তেঘরি, সৈয়দ মোহাম্মদপুর ও বাঙ্গালীপুর, খানপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ ভরতপুর, ঘুঘুদা, গোপালপুর, শেখপাড়া, দূর্বাডাঙ্গা ইউনিয়নের দূর্বাডাঙ্গা, কুশখালি, হরিনা ও কোনাকোলের মানুষের দুর্ভোগের যেন শেষ নেই।

কুলটিয়া ইউনিয়নের সুজাতপুর, হাটগাছা, বাজেকুলটিয়া, চালুয়াহাটি ইউনিয়নের গৌরিপুর, রতনদীয়া, আটঘার ও গুপিকান্তপুর; হরিদাসকাটি ইউনিয়নের নেবুগাতী, পাঁচকাটিয়া, ভুলবাড়ি ও কুচলিয়া, মনোহরপুর ইউনিয়নের খাকুন্দি, বাজিতপুর, ভবানিপুর, মনোহরপুর ও কপালিয়া, মশ্মিমনগর ইউনিয়নের চাকলা, হাকিমপুর ও পারখাজুরা, হরিহরনগর ইউনিয়নের ডুমুরখালি গ্রামের হাজারও পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

Jessore-Flad

পানিবন্দি পরিবারের সদস্যরা বাড়ি-ঘর ছেড়ে আশেপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়কে আশ্রয় নিয়েছেন। ফসল, মাছের ঘের ও বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। টানা বর্ষণে মণিরামপুরে এক হাজার ৩৬৫ হেক্টর জমির ফসল, ৪৬৩টি মাছের ঘের, প্লাবিত হয়েছে। ৫৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া অর্ধশতাধিক কাঁচাবাড়ি ভেঙে গেছে। সবমিলিয়ে পঞ্চাশ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়কের পাশে খুপড়ি ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন মণিরামপুরের হাসাডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা সালেহা বেগম। তিনি বলেন, পানির চাপে তার কাঁচাঘরটি ধসে পড়েছে। এজন্য পুরো পরিবার এখন রাস্তার পাশে খুপড়ি ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। কতদিন এখানে থাকতে হবে তা অনিশ্চিত।

মণিরামপুরের নাগোরঘোপ স্কুলে আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা সোহরাব হোসেন জানান, তাদের বাড়িতে হাঁটু পানি, তাই বাধ্য হয়ে বাড়ি ছেড়েছেন। এখন ঠাঁই হয়েছে স্কুলে।

মণিরামপুরের বিল কেদারিয়ার সততা মৎস্য খামারের সভাপতি শাহাজাহান আলী বলেন, মুক্তেশ্বরী নদী ও টেকা নদী এবং জবরডাঙ্গা খাল দখল করে পাটা স্থাপনের কারণে বৃষ্টির পানি সরছে না। ফলে সেটি বিল কেদারিয়ায় ডুকে পড়ে ঘের ভেড়ি ভেসে যাচ্ছে।

মণিরামপুরের পাশাপাশি কেশবপুরের পৌর এলাকা এবং উপজেলার প্রায় ৪০টি গ্রাম জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। চারদিনের ভারী বর্ষণে অন্তত তিন হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। শত শত পরিবার বাড়ি-ঘর ছেড়ে উঁচু স্থান ও আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। ছয়টি আশ্রয় কেন্দ্রে দুই শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। চার শত হেক্টর ফসল ও তিন হাজার মৎস্য ঘের পানিতে প্লাবিত হয়েছে।

এলাকাবাসী জানায়, কেশবপুর উপজেলার হরিহর ও ভদ্রা নদীর তলদেশ পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি নিষ্কাশিত না হওয়ায় এ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কেশবপুর, মধ্যকুল, ভবানীপুর, কেশবপুর সাহাপাড়া, আলতাপোল, বালিয়াডাঙ্গা, বাজিদপুর, নেহালপুর, বগা, রেজাকাটি, মহাদেবপুর, ডহুরি, কালিচরনপুর, সাগরদত্তকাটি, বেলকাটি, রাজনগর বাকাবর্শি, রামচন্দ্রপুর, সুজাপুর, ব্যাসডাঙ্গা, কোমরপুর, মঙ্গলকোট, গেলাঘাটা, বিদ্যানন্দকাটী, নতুন মূলগ্রাম, মূলগ্রাম গ্রাম, সানতলা, খতিয়াখালি, সুজাপুরসহ উপজেলায় ৪০টি গ্রামের প্রায় তিন হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

Jessore

অনেকে বাড়ি-ঘর ছেড়ে উঁচু স্থান ও আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। গবাদি পশু ও হাস-মুরগি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন পানিবন্দি মানুষ। চারশ হেক্টর ফসল ও তিন হাজার মৎস্য ঘের পানির নীচে নিমজ্জিত হয়েছে।

কেশবপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কেশবপুর আলিয়া মাদরাসা, কেশবপুর মধুশিক্ষা নিকেতন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কেশবপুর মহিলা কলেজ, বালিয়াডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও গণসাহায্য সংস্থার আশ্রয় কেন্দ্রে দুই শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।

কেশবপুর-যশোর সড়কের মধ্যকুলে এবং বালিয়াডাঙ্গা ব্রিজের ওপর বসবাস করার জন্য শতাধিক পরিবার টংঘর তৈরির কাজ করছেন। কেশবপুরের প্রধান সড়ক, পাঁজিয়া ও সাগরদাঁড়ি সড়কের উপর পানি উঠেছে।

কেশবপুর পৌরসভার সাহাপাড়ার খোকন দত্ত বাড়ি ছেড়ে উঁচু স্থানে চলে যাওয়ার সময় তার স্ত্রী স্বপ্না ঘোষ জানান, তার মেয়ে কৃষ্ণা দত্ত সন্তানসম্ভবা। তাকে নিয়ে তিনি খুবই চিন্তায় রয়েছেন। বাড়ি জলমগ্ন হয়ে পড়ায় সাহাপাড়ার সূর্য অধিকারী, মধ্যকুলের রুবেল শেখ, আসমা বেগম ও রবিউল ইসলাম বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।

সাহাপাড়ার খ্রিস্টান মিশনের পেছনে বসবাসকারী যোহন সিংহের স্ত্রী নিলিমা সিংহ তার পোষা ২৮টি ছাগল নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ছাগলের ঘরে পানি ঢুকে পড়ায় সেখানে খাট পেতে উঁচু করে ছাগল রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

কেশবপুরের এস এন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মঙ্গলকোট মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মঙ্গলকোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বালিয়াডাঙ্গা পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সুজাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি উঠে গেছে।

কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) কবীর হোসেন জানান, পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আশ্রয়হীনদের জন্য নয়টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এইচ এম আমির হোসেন প্রতিদিনই কেশবপুরের প্লাবিত অঞ্চল পরিদর্শন করছেন।

অপরদিকে, অভয়নগর উপজেলার প্রেমবাগ ইউনিয়নের মাগুরা, জিয়াডাঙ্গা, বনগ্রাম, চেঙ্গুটিয়া ও বালিয়াডাঙ্গা, সুন্দলী ইউনিয়নের রাজাপুর, রামসরা, আড়পাড়া, হরিসপুর, ফুলেরগাতি, গোবিন্দপুর, সড়াডাঙ্গা, ডহর মশিয়াহাটি, ডাঙ্গা মশিয়াহাটি গ্রাম, পায়রা ইউনিয়নরে দিঘলিয়া, বারান্দি, আড়পাড়া, পায়রাসহ অন্তত ৩০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

উপজেলায় অন্তত তিন হাজার পরিবার ক্ষতিগস্ত হয়েছেন। ১৪০টি কাঁচা বাড়ি-ঘর ধসে গেছে। এছাড়া তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমির মধ্যে এক হাজার ছয়শ হেক্টর আউশ, সাতশ হেক্টর আমন, সবজি ৩৫০ হেক্টর, আমন বীজতলা ৩৪০ হেক্টর পানিতে ডুবে গেছে। প্রায় সাড়ে চার হাজার মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। এতে প্রায় ৬০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

Jessore

অভয়নগরের ডুমুরতলা গ্রামের মনোরঞ্জন বৈরাগী বলেন, বাড়িতে হাঁটু পানি জমে গেছে। ঘরের ভেতর জল ঢুকে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তাই রাস্তার ওপর ঝুপড়ি বাঁধছি।

স্থানীয় ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সমির বৈরাগী জানান, আমার ওয়ার্ডে সাতশ পরিবার জলে ডুবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ঘের ব্যবসায়ী ধোপাদি গ্রামের আবদুর রহিম জানান, সাত বিঘা জমিতে তিনটি ঘের রয়েছে। সবকটি ডুবে গেছে। গত বছরের লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারিনি, এ বছর আবারও ঘের ডুবে যাওয়ায় আমার পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকল না।

ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, বিল কপালিয়ায় টিআরএম চালু না হওয়া, টেকা, মুক্তেশ্বরী নদী ও ভবদহ সংশ্লিষ্ট খাল থেকে পলি অপসারণে পাউবো (পানি উন্নয়ন বোর্ড) কার্যকর ভূমিকা না নেয়ায় এবার বন্যার কারণে ক্ষয়-ক্ষতি অতীতের রেকর্ড অতিক্রমের আশঙ্কা রয়েছে।

এ ব্যাপারে যশোরের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মাজেদুর রহমান খান বলেন, ইতোমধ্যে কেশবপুর উপজেলায় ১০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া মণিরামপুর ও অভয়নগর উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের নেতৃত্বে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তালিকা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হবে।

প্রসঙ্গত, গত বছরও বর্ষা মৌসুমে ভবদহ অঞ্চলের আড়াই শতাধিক গ্রামের মানুষ টানা কয়েক মাস পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেন। সেই সময় জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিলেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে এবারও বর্ষা মৌসুমে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ভবদহ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ। ক’দিনে এ সমস্যার সমাধান হবে সেটিও অনিশ্চিত। এক যুগ আগে স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে ভবদহকে যশোরের দুঃখ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো।

মিলন রহমান/এমএআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।