কমছে যমুনার পানি, গিলছে বাড়ি
যমুনা নদীর পানি কমতে শুরু করায় ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছে টাঙ্গাইলের সাত উপজেলায়। টাঙ্গাইল সদর, ভূঞাপুর, মির্জাপুর, কালিহাতী, দেলদুয়ার, গোপালপুর ও নাগরপুর উপজেলায় যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীর পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙন শুরু হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার ভূঞাপুর স্লুইসগেট পয়েন্টে বিপদসীমার ২৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
জেলার সাতটি উপজেলায় ভয়াবহ ভাঙনে শত শত বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মসজিদ-মাদরাসা যমুনা ও ধলেশ্বরীসহ স্থানীয় নদীগুলোর পেটে চলে যাওয়ায় নদী পাড়ের মানুষের কপাল পুড়ছে।
গত তিনদিনের ভাঙনে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়নের চরপৌলি এলাকার দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, একটি মসজিদ ও একটি মাদরাসাসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং দুই শতাধিক বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
এছাড়া মাহমুদনগর ও কাতুলী ইউনিয়নেও নদীভাঙনের কারণে সর্বস্বান্ত হয়েছে বেশ কয়েকটি পরিবার।
ওইসব পরিবারের লোকজন আশ্রয় নিয়েছে অন্যের বাড়িতে। তবুও যেন যমুনার করাল গ্রাস তাদের পিছু ছাড়ছে না। তাদের আশ্রয়স্থল সেই বাড়িগুলোও এখন হুমকির মুখে। এ কারণে অনেকেই আগে থেকেই তাদের বাড়িঘর, আসবাবপত্রসহ জীবিকার একমাত্র অবলম্বন তাঁতশিল্পের যন্ত্রপাতি সরিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
ভূঞাপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, অর্জুনা ইউনিয়নে ৬০৫টি ও গাবসারা ইউনিয়নে ৬৬৯টি পরিবারের বসতভিটা ভাঙনে যমুনার পেটে চলে গেছে।
এছাড়া বন্যায় অর্জুনা ইউনিয়নে ৩ হাজার ৪৫২টি পরিবার, গাবসারা ইউনিয়নে পাঁচ হাজার ২০০টি পরিবার, নিকরাইল ইউনিয়নে প্রায় ৪ হাজার পরিবার ও গোবিন্দাসী ইউনিয়নের এক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভাঙন ও বন্যায় ক্ষতিগস্ত পরিবারগুলোতে দেখা দিয়েছে নানা রোগ-বালাই। প্রায় প্রতিটি পরিবারেই সর্দি, জ্বর, আমাশয়সহ পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে।
বুধবার টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ভাঙনকবলিত এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মালামাল সরিয়ে নেয়ার জন্য ভালো কোনো রাস্তা না থাকায় নদীপথে নৌকা নিয়ে পরবর্তী বাসস্থানের খোঁজে ছুটছেন ভাঙনকবলিতরা। আবার কেউ কেউ বাড়ি-ঘর ও আসবাবপত্র অন্যের বাড়িতে কিংবা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে রেখে আসছেন।
কাকুয়া ইউনিয়নের চরপৌলী এলাকার স্বামী পরিত্যক্তা আখলিমা। গত বছর তার শেষ সম্বলটুকু যমুনার পেটে চলে যায়। সেই সঙ্গে তার কপালটাই পুড়তে শুরু করে। পরে তিনি আশ্রয় নেয় জয়নাল আবেদিন নামে এক তাঁত মালিকের বাড়িতে। কিন্তু গত কয়েক দিনের ভাঙনে জয়নাল আবেদিনের বাড়িটিও হুমকির মুখে। ফলে বাড়ির মালিক সবকিছু ভেঙে প্রায় দুই কিলোমিটর দূরে আরেক জায়গায় ঘর তৈরির কাজ শুরু করেছেন।
একই এলাকার নুরুন্নাহার, বাছাতন বেগম, আম্বিয়া আক্তার জানান, গত বছর থেকে এবারের ভাঙনের তীব্রতা অনেক বেশি। গত তিনদিনের ভাঙনে তাদের বাড়ি-ঘর সব নদীর পেটে চলে গেছে। আশ্রয় নিয়েছেন একই এলাকার হাছান আলীর বাড়িতে।
তাদের অভিযোগ, তাদের এ দুরবস্থার সময় এলাকার কোনো জনপ্রতিনিধি বা সরকারি কর্মকর্তারা খোঁজ নিতে আসেনি। একই সঙ্গে কোনো প্রকার সরকারি সহযোগিতাও তারা পাননি।
অপরদিকে সদর উপজেলার চরপৌলি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মিন্টু মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়সহ মসজিদ, মাদরাসা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে চরপৌলির বিশাল একটি হাট ও বাজার। এরই মধ্যে বাজারের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী তাদের প্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরিয়ে ফেলেছেন।
মো. হজরত আলী নামে এক মুদি দোকানি জানান, গতবারের তুলনায় এবার বেশি ভাঙন শুরু হয়েছে। দ্রুত ভাঙন রোধ করা না গেলে পুরো ইউনিয়ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তাদের মতো সাধারণ মানুষের যাওয়ার কোনো জায়গা থাকবে না।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মাসুম রেজা প্রধান জানান, বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ১০০ মেট্রিক টন জিআর চাল ও নগদ দুই লাখ টাকা তিনটি উপজেলায় বরাদ্দ দিয়েছে। বিশেষ বরাদ্দ এলে তা যথা নিয়মে বণ্টন করা হবে।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহজাহান সিরাজ জানান, টাঙ্গাইল সদরসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে পানি কমতে থাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। দ্রুত ভাঙন ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
আরিফ উর রহমান টগর/আরএআর/জেআইএম