সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত : ব্যাপক ক্ষতি


প্রকাশিত: ০৭:৫৮ এএম, ০৫ জুলাই ২০১৭

পাহাড়ি ঢল আর টানা বর্ষণে সিলেটের আটটি উপজেলার ৫৫টি ইউনিয়নে দীর্ঘমেয়াদী বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যায় এসব উপজেলায় সহস্রাধিক হেক্টর আউশ ও আমন ধান, ৫ শতাধিক পুকুর ও মৎস্যখামার পানিতে ভেসে গেছে।

এছাড়া সওজের তিনটি সড়কের আংশিক এলাকা ও এলজিইডির ২১৬ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্তসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বুধবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত ছিল।

এদিকে, বন্যাকবলিত এলাকায় পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। চৈত্রের অকাল বন্যায় শতভাগ বোরো ফসলের বিপর্যয়ের পর সাম্প্রতিককালের স্থায়ী বন্যায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। হতদরিদ্র লোকজনের অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটছে।

সরকারি ত্রাণের চাল উপজেলাগুলোর আংশিক এলাকায় কিছু সংখ্যক লোকজনের মধ্যে বিতরণ করা হলেও অধিকাংশ বন্যাদুর্গত মানুষের ভাগ্যে চাল তো দূরের কথা, শুকনো খাবারও জুটছে না। বানভাসি মানুষের জন্য সরকারিভাবে দেয়া যৎ সামান্য এই বরাদ্দ কতটুকু সহায়ক, তা নিয়ে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে।

তবে সিলেট জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সরকারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বন্যায় সিলেটের আটটি উপজেলায় ৫৫টি ইউনিয়ন পরিষদের ৪৬৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩২ হাজার ৮৪৭টি পরিবার। বন্যায় চার হাজার ৩৩০ হেক্টর আউশ ধান ও ৩৫ হেক্টর আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সরকারি এই হিসেবের সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই। বন্যাকবলিত এলাকা ঘুরে ও ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে কথা বলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি বলে জানা গেছে।

জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের বালাগঞ্জ-ওসমানীনগর, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় বন্যার্তদের জন্য ১১টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ১৪৫টি পরিবারের ৬২৯ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। ইতিমধ্যেই বন্যার্তদের সহায়তায় ১২৭ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। নতুন করে আরও ৫০০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

এদিকে সিলেট সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, বন্যা কবলিত এলাকায় বেশ কয়েকটি মেডিকেল টিম কাজ করছে। এসব টিমের মাধ্যমে খাবার পানি বিশুদ্ধ করার এক লাখ ট্যাবলেট বিতরণ করা হচ্ছে। বন্যার্তদের ওরস্যালাইনও প্রদান করা হচ্ছে।

এছাড়া সিভিল সার্জন কার্যালয়ে আরও এক লাখ ৪৭ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও এক লাখ ওরস্যালাইন মজুদ রয়েছে। প্রয়োজনে এগুলো বন্যা কবলিত এলাকায় বিতরণ করা হবে।

সড়ক ও জনপথ (সওজ) সূত্র জানায়, বন্যায় সওজের তিনটি সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব সড়কের ছয় কিলোমিটার পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। পানি সরে গেলে এসব সড়ক যাতে দ্রুত সংস্কার করা যায়, সেজন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। কয়েকদিনের মধ্যে টেন্ডার আহ্বান করা হবে।

বন্যা কবলিত এলাকায় সওজের ৬০টি ট্রাক দিয়ে সংস্কার কাজ চালানো হচ্ছে। সওজের চেয়ে এলজিইডির আওতাধীন সড়কই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত এলজিইডির ২১৬ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

sylhet

সিলেট মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, বন্যায় সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায় সাত হাজার ২৯৪টি পুকুর ভেসে গেছে। এতে এসব পুকুরে থাকা মাছও বেরিয়ে গেছে।

বন্যার কারণে সিলেটের ২০৬টি বিদ্যালয়ে পাঠদান স্থগিত করা হয়েছে বলে শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে। তন্মধ্যে ১৮৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ২১টি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়।

বুধবার দুপুর পর্যন্ত সিলেটের দক্ষিণ সুরমা, বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ওসমানীনগর, গোলাপগঞ্জ, জকিগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ প্রভৃতি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। তবে ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় কিছু কিছু স্থানে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।

গোলাপগঞ্জের ভাদেশ্বরের কাটকাই গ্রামের শহিদুল ইসলাম জানান, বন্যায় পানিবন্দি মানুষেরা বাধ্য হয়েই পানিতে চলাফেরা করছেন। তাই নানা ধরণের চর্মরোগ দেখা দিয়েছে অনেকের। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় তাদের পক্ষে উপজেলা সদরে হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

এছাড়াও জলাবদ্ধ হয়ে থাকা এলাকার শিশুরা নানা ধরণের রোগে ভুগছেন বলেও জানান তিনি।

ওসমানীনগর উপজেলার সাদীপুর ইউনিয়নের গজিয়া গ্রামের বাসিন্দা আলী হোসেন রানা বলেন, বন্যার কারণে বাড়িঘর ও নলকূপ পানিতে ডুবে যাওয়ায় ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে গেছে। আমার ছেলেও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ছিল। তাকে দুদিন হাসপাতালে রাখতে হয়েছে।

ফেঞ্চুগঞ্জের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শফিকুল ইসলাম জানান, এখন পযন্ত ডায়রিয়ার মতো পানিবাহিত রোগের কোনো প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়নি। তবে জলাবদ্ধ থাকায় ও স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ার কারণে শিশুরা শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ার মতো কিছু রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিষয়টি এখনো মহামারীর পর্যায়ে যায়নি বলে জানান তিনি। এছাড়াও বড়রা মূলত চর্মরোগে ভুগছেন।

সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. হিমাংশু লাল রায় জানান, বন্যা কবলিত এলাকায় স্বাস্থ্য বিভাগ প্রতি মুহূর্তে খোঁজখবর রাখছে- যাতে কোনো ধরণের রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে তা মোকাবেলা করা যায়।

সিভিল সার্জন জানান, এখন পর্যন্ত কোনো এলাকাতেই পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাবের সংবাদ পাননি। তবে আশঙ্কা রয়েছে যে কোনো সময় ডায়রিয়ার মতো নানা ধরণের রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ডা. হিমাংশু বলেন, প্রতিটি উপজেলায় পর্যাপ্ত মেডিকেল টিম স্বাস্থ্য সেবা দিতে কাজ করছে এছাড়াও বন্যার সময় সচেতনতা বৃদ্ধিতেও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জরুরি পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে পর্যাপ্ত ঔষধ ও অন্যান্য মেডিকেল দ্রব্যের মজুদ রয়েছে বলে জানান তিনি।

সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বলেন, জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে আমরা প্রতিদিনই বন্যা কবলিতদের পাশে রয়েছি। সরকারি ত্রাণ ও নগদ অর্থ যাতে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কাছে পৌঁছে দেয়া যায় সে লক্ষ্যে জেলা প্রশাসন কাজ করছে।

ছামির মাহমুদ/আরএআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।