মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানালেন এসআই মানস
রিমান্ডের নামে থানা হাজতে এনে দাবি করেছিলেন ৩০ লাখ টাকা। আর তা দিতে অস্বীকার করায় বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয় স্তন ও গোপনাঙ্গে। এতে অজ্ঞান হলেও দেয়া হয় শরীরের আরও কয়েক স্থানে গরম তারের ছ্যাঁকা। এভাবে মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছেন পুলিশের পোশাক পরে হায়নার মনোবৃত্তি পোষণ করা কক্সবাজার থানার এসআই মানস বড়ুয়া।
নিজের উপর ঘটে যাওয়া এসব স্মৃতি উল্লেখ করতে গিয়ে কক্সবাজারের নারী উদ্যোক্তা জীবন আরা কেঁদে ফেলেন।
কক্সবাজার প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি এসআই মানস বড়ুৃয়াকে পুলিশের কলঙ্ক উল্লেখ করে জীবন আরা বলেন, কক্সবাজার শহরতলীর লিংকরোড়স্থ নিজস্ব পাকা ভবনের দ্বিতীয় তলায় অন্যদিনের মতো ব্যবসায়ী স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন তিনি। মাঝ রাতে পুলিশ তাদের ডেকে বাড়িতে ঢুকে।
কিছু বুঝে উঠার আগেই বাড়ি তল্লাসির কথা বলে সবাইকে চোখ বেঁধে এক কোণে বসিয়ে রাখা হয়। এরপর এক পুলিশ বলে উঠে স্যার ইয়াবা পাওয়া গেছে। বাড়িতে ইয়াবা পাওয়ার কথা বলে রাতেই স্বামী আলী আহমদ সওদাগর ও তাকে থানায় এনে হাজতে রাখা হয়।
তাদের আনার সময় পুলিশ তার বাসা থেকে ব্যাংক চেক, স্বর্ণালংকার ও একটি প্রাইভেট কারও নিয়ে যায়। কিন্তু সিজার লিস্টে গাড়িটি জব্দের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়নি। স্বামী-স্ত্রীকে তিনদিন থানা হাজতে রেখে মাদক মামলায় জীবন আরাকে এক নাম্বার আসামি করে চালান দেয়া হয়।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, কারাগারে নেয়ার দশদিন পর রিমান্ডের নামে জীবন আরাকে থানায় এনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মানস বড়ুয়া প্রথমে তার স্বজনদের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা দাবি করেন। সেই টাকা দিতে অনিহা প্রকাশ করায় মধ্যযুগীয় কায়দায় তার স্তন ও গোপনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়। এতে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। জ্ঞান ফেরার পর দেখেন শরীরের আরও কয়েক স্থানে গরম ছ্যাঁকার ফসকা পড়েছে।
এ অবস্থায় তাকে কারাগারে দিয়ে আসা হয়। বিনা চিকিৎসায় থাকায় বৈদ্যুতিক শকের ক্ষতস্থান থেকে পচা গন্ধ বের হলে কারা কর্তৃপক্ষ পরে সদর হাসপাতালে পাঠান। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের নথিতে বৈদ্যুতিক শকের কথা উল্লেখ করেছেন। এসব কথা উল্লেখ করে উন্নত চিকিৎসার জন্য আদালতে জামিন চাওয়া হয়। আদালত নারী কর্মকর্তা দিয়ে চেকআপ করার পর তথ্যের সত্যতা পেয়ে অবশেষে জামিন দেয়।
ঘটনার খবর পেয়ে নারী কল্যাণ সমিতি তার পক্ষে হাটছে দেখে তার পরিবারের উপর নেমে আসে পুলিশি হয়রানির খড়গ। কোথাও কোনো অভিযোগ কিংবা কিছু করা হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে কড়া নজরদারি বসায় পুলিশ। কক্সবাজার হাসপাতালে পুলিশ বার বার ডিস্টার্ব করছে দেখে জীবন আরাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চমেকে তার শারীরিক অবস্থা দেখে তাকে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়। চিকিৎসকরা বলছেন, যথাযথ চিকিৎসা না পেলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারেন জীবন আরা।
কেন এ পুলিশী হয়রানি? এমন প্রশ্ন করা হলে জীবন আরা বলেন, তিনি একজন নারী উদ্যোক্তা। নিজ ভবনে তার একটি বিউটি পার্লার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। যেখানে প্রতি তিনমাস অন্তর এক ব্যাচে ১৫ নারীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এ নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কারও পেয়েছেন। পেয়েছেন সরকারি উদ্যোক্তা ঋণও। এ সুবাদে পরিচয় হয় ঢাকার পশ্চিম উত্তরার কামালপাড়ার সিরাজুল হকের স্ত্রী সীমা আক্তারের সঙ্গে।
তিনি কক্সবাজার এসে ঢাকায় যৌথ মূলধনে একটি পার্লার করার প্রস্তাব দেন। তার কথায় বিশ্বাস এনে রাজি হয়ে চুক্তির পর ২৩ লাখ টাকাও দেয়া হয়। এটিই কাল হয়েছে তার। সীমা ব্যবসা খোলার পরিবর্তে সে টাকায় ঢাকায় বাড়ি নিমার্ণ করছেন। জানতে পেরে ঢাকায় গিয়ে তিনি নোটারির মাধ্যমে ২৩ লাখ টাকার পরিবর্তে তার ব্যবহৃত একটি কার বন্ধক দেন। কথা ছিল টাকা পরিশোধ করে গাড়ি নিয়ে যাবেন। কিন্তু তা না করে ১০ লাখ টাকায় কক্সবাজার সদর থানার ওসিসহ কয়েক অফিসারের চুক্তি করে জীবন আরাকে ফাঁসানোর পরিকল্পনা করেন। তার বাস্তবায়ন স্বরূপ তারা স্বামী-স্ত্রীকে ইয়াবা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে সীমার কারটি তাকে ফেরত দিয়েছে পুলিশ। অথচ তার সঙ্গে করা ডিড ও গাড়ির সমস্থ কাগজপত্র এখনো তার হেফাজতে রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। আদালতের মাধ্যমে জামিনে এলেও আটকের দিন বাড়ি থেকে নিয়ে আসা জিনিসের হদিসও দিচ্ছেনা পুলিশ।
সীমার দেয়া টাকা হজমের পর ব্যবসায়ী স্বামীর কাছ থেকে টাকা আদায়ে ওসিসহ অন্যরা পরিকল্পনা করে তার উপর মধ্যযুগীয় বর্বরতা চালান বলে উল্লেখ করেন তিনি। কারাগার থেকে বের হয়ে নির্যাতনের সঠিক বিচার পেতে সহায়তার জন্য শহরের ঝাউতলা নারী কল্যাণ সমিতিতে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে পুলিশ আবার তার ওপর হামলা চালায়। ওইসময় নুনিয়ারছড়া এলাকায় ইট দিয়ে পিটিয়ে তার দেবর জাহাঙ্গীরের পা ভেঙে দেন এসআই মানস।
জীবন আরা আরও জানান, সদর থানা পুলিশের পরিকল্পনায় এসআই মানস বড়ুয়ার অমানবিক নির্যাতনের বিষয় উল্লেখ করে কক্সবাজারের পুলিশ সুপারসহ পুলিশ সদর দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেন তিনি। বিষয়টি লিখিতভাবে জানানো হয়েছে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকেও। এ ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও সুবিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী জীবন আরা।
সংবাদ সম্মেলনে কক্সবাজার নারী কল্যাণ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ফাতেমা নার্গিস ডেজী, সাধারণ সম্পাদক হোসনে আরা ও অর্থ সম্পাদক রেহেনা আক্তার পাখিসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। নির্যাতনের ন্যায় বিচার নিশ্চিত না হলে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা দেবেন বলে জানান নারী নেতৃবৃন্দ।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে এসআই মানস বড়ুয়ার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন বলেন, অভিযোগকারী আমার তদন্তাধীন মামলার আসামি। তাই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতেই পারেন। এতে আমার কিছুই হবে না।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেন বলেন, একজন নারীকে আমার এক এসআই কর্তৃক নির্যাতনের লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তদন্ত করছেন। উভয়ের অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যারটা প্রমাণ হবে তার বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সায়ীদ আলমগীর/এমএএস/আরআইপি