বাঁশের লাঠি নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণের ঘটনা ইতিহাসে বিরল


প্রকাশিত: ০৩:৩৪ পিএম, ২৫ মার্চ ২০১৭

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। সুদীর্ঘ সময়ের সিঁড়ি বেয়ে ইতিহাসের পৃষ্ঠা রক্তে রাঙিয়ে সেদিন নতুন সূর্য উঠেছিল বাংলার আকাশে। পোড়া লাশের গন্ধ, ভাই হারা বোনের আর্তনাদ, মায়ের বুক ভেজা কান্না নিয়ে বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই শুরু হয়েছিল সেদিন।

আত্মত্যাগের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত  সৃষ্টি করে সেদিন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই দেশের আপামর জনতা। আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধটা সেদিন শুরু হলেও রংপুরের মানুষ তারও আগেই বুঝেছিল পেছনে ফেরার কোনো পথ নেই আর। ৩ মার্চ কিশোর শংকু সমাজদারের রক্ত সে কথাই জানিয়ে দিয়েছিল সেদিন। একাত্তরের সেই ভয়াল দিনগুলো নিয়ে কথা হয় রংপুর মহানগর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সদরুল আলম দুলুর সঙ্গে।

তিনি জানান, মূলত রংপুরে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল ৩ মার্চ। ওদিন বঙ্গবন্ধু সারা দেশে হরতাল ডাকেন। হরতাল সফল করতে ৩ মার্চ দলমত নির্বিশেষে সবাই শহরের জিরো পয়েন্ট কাছারি বাজারে জমায়েত হন।

তখনো অল্পসংখ্যক মানুষ। কিন্তু মিছিলটি বের হওয়ার পরই আস্ত আস্তে তা রূপ নেয় বিশাল মিছিলে। সেই মিছিলে ছিলেন রফিকুল ইসলাম গোলাপ, মমতাজ জাকির আহমেদ সাবু, সিদ্দিক হোসেন, শেখ আমজাদ হোসেন, ইছাহাক চৌধুরী, হারেস উদ্দিন সরকার, নুরুল হক, মুকুল মোস্তাফিজ, অলক সরকার, ইলিয়াস আহমেদ, আবুল মনসুর আহমেদ, খন্দকার গোলাম মোস্তফা বাটুল, তৈয়বুর রহমান বাবু, মুসলিম উদ্দিন কমিশনার, মাহবুবুল বারী, জায়েদুল আলম, মোফাজ্জল হোসেনসহ হাজারো বীর জনতা।

মিছিলটি তৎকালীন তেঁতুলতলায় (বর্তমান শাপলা চত্বর) পৌঁছলে সেখানে শহীদ মুখতার ইলাহী, শহীদ রনী রহমান ও জিয়াউল হক সেবুর নেতৃত্বে কারমাইকেল কলেজ থেকে আরেকটি মিছিল যোগ দেয়। সেদিনের ওই মিছিল রেলস্টেশন হয়ে ফিরে আসার পথে বর্তমান ঘোড়াপীর মাজারের সামনের তৎকালীন অবাঙালি সরফরাজ খানের বাসার ওপর উর্দুতে লেখা একটি সাইনবোর্ড চোখে পড়ে মিছিলকারীদের।

তাৎক্ষণিক ওই সাইনবোর্ড নামাতে এগিয়ে যান মিছিলকারী সপ্তম শ্রেণির ছাত্র শংকু সমাজদার, মকবুল হোসেন, শফিকুলসহ অনেকেই। আর ঠিক তখনই ওই বাসা থেকে চালানো হয় গুলি। গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন শংকু ও তৎকালীন কারমাইকেল কলেজের ছাত্রলীগ কর্মী শফিকুল।

সহযোদ্ধারা আহত শংকু ও শফিকুলকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু পথেই ১২ বছরের বিপ্লবী কিশোর শংকু মৃত্যুবরণ করেন। সেদিনই রংপুরের প্রথম শহীদ হওয়ার গৌরব অর্জিত হয় ছোট্ট ছেলে শংকুর। আর দীর্ঘ এক মাসেরও বেশি সময় চিকিৎসাধীন থেকে মারা যান শফিকুল।

এ বিষয়ে সদরুল আলম দুলু জানান, শংকুর মৃত্যু সংবাদ শহরময় ছড়িয়ে পড়লে গোটা শহর রূপ নেয় এক ভয়াল শহরে। উত্তাল হয়ে ওঠে রাজপথ। আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলে ওঠে শহরে।

বাঙালিদের ক্ষোভের আগুনে জ্বলতে থাকে অবাঙালিদের বাড়িঘর, দোকান ও প্রতিষ্ঠান। মূলত সেদিনের সেই ঘটনার মধ্য দিয়েই রংপুরে সূচনা হয় মুক্তিযুদ্ধের।

ফলশ্রুতিতে সন্ধ্যা থেকে কারফিউ জারি করা হয় শহরজুড়ে। এরপর আসে সেই ভয়াল ২৫ মার্চ। ওদিন দুপুরের পরপরই শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে অপহরণ করা হয় শান্তি চাকী, খুররম, মহররম, জররেজ, দুলাল, গোপাল চন্দ্র, উত্তম কুমার অধিকারী, সতীশ হাওলাদার, দুর্গা দাসসহ ১১ জনকে। এরপর ৩ এপ্রিল দখিগঞ্জ শশ্মানে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়।

তিনি আরও জানান, ২৫ মার্চের রাত ১০টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে শুরু হয় গোলাগুলি। বিশেষ করে ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন ভগী, ধাপ, রামপুরা, পার্বতীপুর, বখতিয়ারপুর, নিসবেতগঞ্জ, পীরজাবাদের বাড়িঘর ফাঁকা হয়ে যায়। জীবনের ভয়ে সাধারণ মানুষ নদীর দ্বারে ও খেত-খামারে আশ্রয় নেয়।

২৬ মার্চ যুদ্ধ ঘোষণার একদিন পর ২৮ মার্চ রংপুরের মানুষ জেগে উঠেছিল এক নবচেতনায়। স্বাধীনতা চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষ রংপুরের বিভিন্ন অঞ্চল হতে লাঠিসোটা, তীর ধনুক, বল্লম নিয়ে বেলা ৩টার দিকে রংপুর ক্যান্টমেন্ট আক্রমণ করে।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বাঁশের লাঠি আর তীর-ধনুক নিয়ে পাকিস্তানি হায়েনাদের আবাসস্থল ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের ঘটনা ইতিহাসে বিরল একটি ঘটনা। এমনি এক ঘটনাই সেদিন ঘটিয়েছিলেন রংপুরের বীর জনতা। ক্যান্টমেন্টের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্যরা এই সমস্ত বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং অসংখ্য মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

সদরুল আলম দুলু জানান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র রংপুরে। ৩ এপ্রিল মধ্যরাতে দখিগঞ্জ শশ্মানে ওই ১১ জনকে হত্যার পর ৪ এপ্রিল তিনি ভারতে পালিয়ে যান। সেখানে দেড় মাস প্রশিক্ষণ শেষে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রামসহ রংপুরের বিভিন্ন এলাকায় সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন।

তিনি জানান, ক্রমেই বলারখাইল গণহত্যা, ঝাড়ুদার বিল ও পদ্মপুকুরের গণহত্যা, জয়রাম আনোয়ার মৌজার গণহত্যা, সাহেবগঞ্জের গণহত্যা, লাহিড়ীরহাটের গণহত্যা, ঘাঘটপাড়ের গণহত্যা, নিসবেতগঞ্জ গণহত্যা, দমদমা ব্রিজ গণহত্যা, জাফরগঞ্জ গণহত্যাসহ বিভিন্ন নৃশংস হত্যাকাণ্ডে রংপুরবাসী তাদের প্রিয়জনকে হারায়। এ সময় হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের কেন্দ্রস্থল ছিল রংপুর টাউন হল।

এভাবেই কেটে যায় প্রায় ৯ মাস। এরপর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করার মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয় রংপুর অঞ্চল। ৯ মাস অবরুদ্ধ মানুষ খুঁজে পায় মুক্তির পথ।

অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের দেশপ্রেম, অগণিত মানুষের আত্মত্যাগ আর মা-বোনের ত্যাগের বিনিময়ে রংপুরে উদিত হয় স্বাধীনতার লাল সূর্য। বিশ্বের বুকে জন্ম নেয় নতুন এক দেশ, বাংলাদেশ।

জিতু কবীর/এএম/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।