আত্মপ্রত্যয়ী লিপির ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প


প্রকাশিত: ০৯:৩৩ এএম, ০৮ মার্চ ২০১৭

আত্মবিশ্বাস আর পরিশ্রমই যে একজন মানুষকে সাফল্য এনে দিতে পারে তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত লিপি। পুরো নাম ফারহানা আফরোজ লিপি। সংসারের অভাব ঘুচানো আর লেখা-পড়ার খরচ জোটাতে এক সময় যাকে কাজের সন্ধানে বের হতে হয়েছিল আজ তিনিই একজন সফল আইটিসি উদ্যোক্তা।

তার গড়া কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষিত হয়ে অনেকেই আজ প্রতিষ্ঠিত। নিজেও পড়াশুনায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। শ্রেষ্ঠ আইসিটি উদ্যোক্তা হিসেবে দুবার স্বর্ণপদকও পেয়েছেন নারী উদ্যোক্তা লিপি।

লিপির চলার পথটা অতটা মসৃণ ছিল না। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টাকে অনেকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতো। লক্ষ্যে পৌঁছার ইচ্ছায় সেসব গায়ে মাখেননি আত্মপ্রত্যয়ী নারী লিপি। এখন লিপিকে সবাই সন্মান করে কথা বলেন। সবার ‘লিপি আপ’` তিনি।

পেছনের গল্প
এসএসসি পাস করে সবে এইচএসসিতে ভর্তি হয়েছেন লিপি। হঠাৎই বাবা মারা যান তার। দুই ভাই, দুই বোন আর মাকে নিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবারে বাবাই ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারটা এলোমেলো হয়ে যায়। বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায়। বড় ভাইও বিয়ে করে আলাদা হন। মা আর ছোট ভাইকে নিয়ে বিপদে পড়ে যান লিপি। প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের লেখা-পড়ার খরচ মিটলেও, সংসার আর ছোট ভাইয়ের পড়াশুনার খরচ জোটানো কষ্টকর হয়ে পড়ে।

Manikgonj

সিদ্ধান্ত নেন কিছু একটা করতে হবে। পাঞ্জাবি সেলাইয়ের কাজ নেন একটি এনজিও থেকে। কিন্তু ঈদ-পূজা ছাড়া সারা বছর এই কাজের চাহিদা নেই। সংসার চলে না। তাই কাজ নেন একটি দর্জি দোকানে।

২০০৩ সালের কথা। মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডস্থ পৌর সুপার মার্কেটে একটি কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার দেখেন লিপি। সেসময় জেলা শহরে হাতে গোনা দু’একটি ট্রেনিং সেন্টার ছিল। লিপি ট্রেনিং সেন্টারে গিয়ে কম্পিউটার শেখার আগ্রহের কথা জানান। তার জীবনের গল্প শুনে মায়া হয় ট্রেনিং সেন্টার মালিক রিপনের। বিনামূল্যে কম্পিউটার শেখান তাকে।

ছয় মাসের মধ্যেই লিপি মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল, ফটোসপসহ কয়েকটি প্রোগ্রামিং সফটওয়্যার সম্পর্কে ভালো ধারণা নেন। এরপর ওই ট্রেনিং সেন্টারেই ২ হাজার টাকা বেতনে প্রশিক্ষক হিসেবে চাকরি শুরু করেন তিনি। নিজে শিখছেন অন্যদেরও শেখাচ্ছেন।

এভাবে কয়েক বছর চলার পর নিজেই একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। একদিন বড় ভাইকে বিষয়টি জানালেন। বোনের ইচ্ছার কথা শুনে বড় ভাই একটি কম্পিউটার কিনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু কম্পিউটার হলেই তো চলবে না চাই ঘর এবং প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র।

পৌর মার্কেটের মালিক সমিতির নেতাদের ধরে জামানতের অগ্রীম টাকা ছাড়াই একটি দোকান নিলেন লিপি। ধারদেনা করে কিনলেন কিছু আসবাবপত্র। একটি মাত্র কম্পিউটার দিয়ে শুরু হলো লিপি কম্পিউটার ট্টেনিং সেন্টারের যাত্রা। শুরুতে তার প্রশিক্ষণার্থী ভর্তি হলো দুইজন। অনেক বাধা বিপত্তি থাকলেও এর পরের গল্পটা শুধুই এগিয়ে যাওয়ার।

Manikganj

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা। তবে লেখাপড়া ছাড়েননি তিনি। মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। মাঝে বিয়েও করেছেন। বিয়ের পর তাকে সহযোগিতা করছেন তার স্বামী রকিবুল হাসান পাভেল। তিনিও যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে কম্পিউটার বেসিক, পোশাক তৈরি, মৎস চাষসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে সফল এক আত্মকর্মী।

মাত্র একটি দিয়ে শুরু করা লিপির ট্রেনিং সেন্টারে বর্তমান কম্পিউটার রয়েছে ১৫টি। প্রশিক্ষণার্থী রয়েছেন ৮০ জন।

লিপি কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারের প্রশিক্ষণার্থী তাসলিমা আক্তার জানান, লিপি আপা খুব যত্ন করে আমাদের শেখান। তার জীবনের গল্প শুনে আমরাও অনুপ্রেরণা পাই।

শেফালী নামে আরেক নারী জানান, লিপি আপার কাছ থেকে ট্রেনিং নিয়েছি। ইচ্ছে আছে তার মতো আমি নিজেও একটি ট্রেনিং সেন্টার খুলবো।

২০১৫ সালে ওয়ার্ল্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি ফাউন্ডেশন থেকে শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা হিসবে ক্রেস্ট ও স্বর্ণপদক পান লিপি। এর আগে ২০১১ সালে তথ্যপ্রযুক্তির প্রশিক্ষণ ও দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে বিশেষ অবদানের জন্য ওয়ার্ল্ড আইসিটি গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ডে ঢাকা বিভাগে লিপি কম্পিউটার প্রথম  হন। অনুষ্ঠানে তাকে স্বর্ণপদক দেয়া হয়।

ফারহানা আফরোজ লিপি জাগো নিউজকে জানান, জীবনে বাধা-বিপত্তি আর ঘাত-প্রতিঘাত আসতেই পারে। তাই বলে পিছিয়ে গেলে হবে না। লক্ষ্য ঠিক রেখে এগিয়ে যেতে হবে। কষ্টের মাঝে কোনো কিছু পাওয়ার আনন্দও একটু বেশি।

ভবিষৎতে শিশুদের জন্য একটি কম্পিউটার স্কুল প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছে আছে লিপির। যেখানে গরীব ও মেধাবীদের বিনা খরচে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।

এফএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।