বাদ পড়লেন সেই ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’
অবশেষে তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার সেই বিতর্কিত ‘মুক্তিযোদ্ধা’ মতিউর রহমান সরকার।
বৃহস্পতিবার যাচাই-বাছাই কমিটির প্রতিবেদন প্রকশ হওয়ার পর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের সহযোগিতা করা ছাড়াও নানা ভূমিকার জন্য এলাকায় তিনি ছিলেন বিতর্কিত। অভিযোগ রয়েছে, তার বাবা ছিলেন শান্তি কমিটির সভাপতি। আর রাজাকার হয়েও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম উঠা মতিউর রহমান সরকার পাচ্ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারের ভাতাও।
মুক্তিযোদ্ধার কোটায় পুলিশে চাকরি পেয়েছেন তার এক ছেলে। বর্তমানে তিনি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আরেক মেয়ে সরকারি স্কুলে চাকরি পেয়েছেন। প্রভাব আর অর্থের জোরে এগারসিন্দুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হয়েছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হল।
এলাকার মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষ তার অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। দাবি উঠে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে তার নাম বাদ দেয়ার। অবশেষে যাচাই-বাছাই শেষে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে তার নাম বাদ দেয়া হলো। পাকুন্দিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি মো. মতিউর রহমান সরকারের আবেদন নামঞ্জুর করেছেন।
গতে ১৬ ফেব্রুয়ারি উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটির প্রতিবেদনে মো. মতিউর রহমান সরকারের আবেদন নামঞ্জুর করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি জেলা মুক্তিযোদ্ধা ডেপুটি কমাণ্ডার আ. মান্নান, সদস্য সচিব পাকুন্দিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কবীর উদ্দীন, পাকুন্দিয়া উপজেলা কমান্ডার মো. মিছবাহ উদ্দিনসহ জামুকার প্রতিনিধি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমাণ্ড কাউন্সিলের প্রতিনিধিদের স্বাক্ষর রয়েছে।
কমিটি কর্তৃক আবেদন নামঞ্জুরকৃত গেজেট ও সাময়িক সনদধারীদের আবেদনের তালিকা ও সিদ্ধান্তের প্রতিবেদনে ৫১ জনের আবেদন নামঞ্জুর করা হয়। এখানে মো. মতিউর রহমানের নাম আছে ২৯নং ক্রমিকে। ওই তালিকায় দেখা যায় মো. মতিউর রহমান সরকার এফ এফ ভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম তালিকাভুক্ত করার জন্য আবেদন করেন।
তিনি যে মুক্তিযোদ্ধা-তার স্বপক্ষে আবেদন ফরমের সঙ্গে সাময়িক সনদপত্র, মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত গেজেট, প্রত্যয়নপত্র ও জাতীয় পরিচয়পত্র দাখিল করেন। যাচাই-বাছাইয়ের সময় উপস্থিত করেন কয়েকজন সাক্ষীও। তবে কমিটি তাদের প্রতিবেদনে ‘উপস্থিত সাক্ষীদের বর্ণনা সন্তোষজনক নয়’ বলে উল্লেখ করেন।
এলাকাবাসী বলছেন, ‘ভুয়া’ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার-অ্যাডিশনাল এসপি) হয়েছেন তার ছেলে শামসুল আলম সরকার লিটন। বর্তমানে শামসুল আলম ফেনী জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন।
এতোদিন বিষয়টি গোপন থাকলেও একজন রাজাকারের মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম ওঠার প্রতিবাদে সোচ্চার হয় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসী। সেই সঙ্গে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পদে তার ছেলেকে নিয়োগ দেয়ায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দেয়।
এ ঘটনার পর ‘রাজাকার’ মতিউর রহমান সরকারের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ দেয়া, সাময়িক সনদ বাতিল, সস্মানী ভাতা বন্ধসহ তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন করেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ২০০৫ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকার সময় কতিপয় মুক্তিযোদ্ধাকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে নিজের নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন মতিউর রহমান। বর্তমানে তিনি সরকারের সম্মানী ভাতা পাচ্ছেন এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তার ছেলের চাকরি হয়েছে সহকারী পুলিশ সুপার পদে।
এ ব্যাপারে গত ৪ জানুয়ারি পাকুন্দিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকতার কাছে স্থানীয় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন।
পাকুন্দিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ড কাউন্সিলের ডেপুটি কমাণ্ডার আ. মান্নান বলেন, মো. মতিউর রহমান যেসব সাক্ষী হাজির করেছিলেন তাদের বক্তব্য কমিটির কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি। তাই তার আবেদন নামঞ্জুর করা হয়েছে।
এদিকে, পাকুন্দিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকায় নাম উঠানোর জন্য জামুকার মাধ্যমে এক হাজার ৪৭১ জন করলেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ২৫ জন। অপরদিকে এক তালিকায় নাম থাকা ১৬৫ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে যাচাই-বাছাইয়ে টিকেছেন ১০০ জন।
প্রসঙ্গত, গত ১৫ জানুয়ারি জাগোনিউজে ‘ভুয়া’ মুক্তিযোদ্ধার ছেলে অ্যাডিশনাল এসপি’ শিরোনামে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে এ নিয়ে এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়।
নূর মোহাম্মদ/এআরএ/জেআইএম