শহীদ মিনারের কারিগর নওগাঁর ডা. মঞ্জুর হোসেন


প্রকাশিত: ১১:১০ এএম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

একুশ যায়, একুশ আসে। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে কালো ব্যাচ পরে শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।

১৯৫২ সালের পর হতে নিয়মিতভাবে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সরকারি-বেসকারি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে এ দিন পালন করে।

কিন্তু যাদের বিনিময়ে এর সূচনা তার সঠিক ইতিহাস আমাদের অনেকেরই অজানা। যারা জীবনকে বাজী রেখে সংগ্রাম করেছিল যাদের অনুপ্রেরণায় জাতী আজ স্বাধীন। আমরা বাংলায় মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারছি। যার হাতে তৈরি হয়েছিল প্রথম শহীদ মিনার তিনি হচ্ছেন ডা. মঞ্জুর হোসেন। পাঠ্য বইয়ের সিলেবাসে ভাষা সৈনিকদের আত্মজীবনী তুলে ধরা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের মর্যাদা প্রদান করার দাবি জানান সচেতন মহল।

জানা যায়, নওগাঁ সদর উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান ডা. মঞ্জুর হোসেন। ১৯২৮ সালে ১৫ জুন জন্মগ্রহণ এবং ১৯৬৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। বাবা মোবারক আলী ও মা নুরুন নাহার। ১৯৪৩ সালে নওগাঁ কেডি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসি, ১৯৪৫ সালে কলকাতা থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৫৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডিগ্রি অর্জন করেও চাকরি না করে আজীবন সাধারণ মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। এমবিবিএস পাস করে নিজ জন্মভূমিতে পেশাজীবন শুরু করেন।

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত গ্রামের সাধারণ মানুষের পাশে থেকে তাদের চিকিৎসা প্রদান করেছেন। গরিব রোগীদের বিনা টাকায় চিকিৎসা এমনকী তাদের ওষুধ পর্যন্ত কিনে দিতেন। অনেক রোগীকে নিজ খরচে ঢাকা পাঠিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন।

চিকিৎসার পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকতার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। তার বাবার উদ্যোগ ও সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক দেশ বানী’র সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৯৬০ সাল থেকে। পত্রিকা প্রকাশ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় কারাদণ্ডসহ নানা নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। তিনি আবৃত্তি, সংগীতচর্চা ও লেখালেখি করতেন।  

ডা. মঞ্জুর হোসেন বায়ান্নর ভাষা আান্দোলনে অত্যন্ত সাহসী ও সংগ্রামী ভূমিকায় ছিলেন। তখন তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র। ১৯৪৯ সালে সরকারি স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ দিবসে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি হলে সেদিন সন্ধ্যায় সাহসী ও দৃপ্ত কন্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন ‘চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙবোই ভাঙবো। এর প্রতিবাদে মেডিকেল ব্যারাকে গোলাম মাওলার রুমে এক স্বতস্ফুর্ত সমাবেশে তিনি জোরালো বক্তব্য রাখেন।

২১ ফেব্রুয়ারি আমতলার সভায় ছাত্র জমায়েত সভাকে স্বার্থক করতে ঢাকা মেডিকেলের সঙ্গে সরাসরি যোগযোগ করেন। বিভিন্ন বিষয়ে সাহসিকতার ভূমিকা রাখায় সহযোদ্ধারা তাকে বিপ্লব দা উপাধি দিয়েছিল।

এছাড়াও তিনি ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে নেতৃত্ব দেন এবং মিছিল করেন। আন্দোলন করায় তিনি গ্রেফতার হন এবং কারাভোগ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারের অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। যে কয়েক জনের হাতের স্পর্শে প্রথম শহীদ মিনার র্নিমাণ হয়েছিল তাদের মধ্যে তিনি একজন ডা. মঞ্জুর হোসেন। তিনি ভাষা-আন্দোলন ছাড়াও পরবর্তীকালে সংঘটিত এ দেশের বহু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৈনিক ছিলেন।

রাজনৈতিক জীবনে তিনি ছিলেন একজন নির্লোভ, ত্যাগী সৎ ও আদর্শ মানুষ। সারাজীবন সংসার ও নিজের জন্য কিছু না করে নওগাঁবাসী তথা দেশ ও জাতির জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন। ছাত্রজীবনে বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এর রাজশাহী জেলার সভাপতি পদে আসীন ছিলেন। অথচ স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরও রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো মর্যাদা পাননি তিনি অথবা তার পরিবার।

নওগাঁর স্থানীয় একটি সামাজিক সংগঠন ‘একুশে পরিষদ’ তাদের নিজস্ব গবেষণায় ডা. মঞ্জুর হোসেনের ইতিহাস তুলে ধরেন। ১৯৯৫ সালে তাকে একুশে পরিষদের পক্ষ হতে মরণত্তর পদক প্রদান করেন।

ডা. মঞ্জুর হোসেনের ছেলে কাউন্সিলর হাসান ইমাম তমাল বলেন, যে ১১ জন এর নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভাঙা হয় তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন আমার বাবা। অথচ তাদের নেই কোনো রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। ২০০২ সালে বাবাকে একুশে পদক দেওয়া হয়। সরকারের উচিৎ পাঠ্য বইয়ের সিলেবাসে ভাষা সৈনিকদের আত্মজীবনী তুলে ধরা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের মর্যাদা প্রদান করা।

এমএএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।