হারিয়ে যাচ্ছে যশোরের ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস


প্রকাশিত: ০৫:৪১ এএম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

কালের আবর্তে হারিয়ে যেতে বসেছে যশোরের ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস। দুই-একজন ভাষা সৈনিকের নামে স্মৃতি-স্মারক থাকলেও অধিকাংশের নামই মুছে যেতে বসেছে। যাদের নামে স্মৃতি-স্মারক আছে, তাদের ইতিহাসও নতুন প্রজন্ম জানে না। আর এ নিয়ে তেমন লেখা-লিখি বা গবেষণাও চোখে পড়ে না। যদিও ভাষার দাবিতে ৪৭/৪৮ সালেই যশোরের মানুষ ফুঁসে উঠেছিল।   

কবি সাঈদ হাফিজ ও  প্রতিশিল্প লিটল ম্যাগ সম্পাদক মারুফুল আলমের নিবন্ধ থেকে জানা যায়, ভারত ভাগের ঠিক আগ মুহূর্তে যশোরের সচেতন কিছু ছাত্র বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় গর্জে ওঠে।

১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ’দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় বাংলা ভাষাকে কটাক্ষ করে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের সাহসী ছাত্রী হামিদা রহমান। তিনি বাংলা ভাষার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে একটি চিঠি লেখেন। এই চিঠিটি নিবন্ধ আকারে ১০ জুলাই কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। পরে যশোর থেকেই ভাষা আন্দোলনের দামামা বেঁজে ওঠে।

৪৮’এ ভাষার দাবিতে আন্দোলন চলাকালে মিছিলে থাকা যশোর ইনস্টিটিউটের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক রবিউল আলম বলেন, ‘তখন আমার বয়স ১৭/১৮। যশোর এমএম কলেজে পড়ি। গুলজার খান নামে পাকিস্তানি এক এসপি আন্দোলন থামাতে ভাষা সৈনিকদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেন। সে সময়ে গাঁ ঢাকা দিতে হয়। কিন্তু আন্দোলন শেষ করে দিতে পারেনি।

Jessore
আলমগীর সিদ্দিকী, আফসার আহমদ সিদ্দিকী, সুধীর কুমার, হামিদা রহমান প্রমুখ সক্রিয় ছিলেন এই আন্দোলনে।’ সে সময়ে এদেশে মিডিয়া এতো শক্তিশালী না থাকায় ইতিহাস সেভাবে উঠে আসেনি। সে সময় যশোরে গঠিত হয়েছিল ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। এই পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক আলমগীর সিদ্দিকীর নামে যশোর ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে একটি হলের নামকরণ হয়েছে। যদিও অপর যুগ্ম-আহ্বায়ক রঞ্জিত মিত্রের নাম এখন অনেকেই ভুলে গেছেন।

বিট্রিশ শাসনামলে কলকাতায় মাতৃভাষা বাংলাকে ব্যঙ্গ করায় যশোরের মাইকেল মধুসূদন কলেজের সাহসী কন্যা হামিদা রহমান প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তার নামে একটি ছাত্রীনিবাস করা হয়েছে যশোর সরকারি এমএম কলেজে। যদিও ওই কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনেকেই হামিদা রহমানের ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস জানেন না।

সামাজিক কারণে বিমল রায় চৌধুরী, আফসার আহমদ সিদ্দিকী, সুধীর কুমার রায়কে মানুষ চিনলেও ভাষা সৈনিক হিসাবে তাদের পরিচিতি বা স্বীকৃতি মেলেনি আজো। মুছে গেছে  ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’র মনোনীত সদস্য দেবীপদ চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ আফজাল  হোসেন, অশোক ঘোষ, সুনীল রায়, হায়বাতুল্লা জোয়ার্দ্দার, আব্দুর রাকীব, আব্দুল হক, শেখ আমানুল্লাহ প্রমুখের নাম।

Jessore
অপর ভাষা সৈনিক বেজপাড়ার আমির আহমদের নামে এলাকাবাসী দরবেশবাড়ির পাশ ঘেঁষে চলে যাওয়া রাস্তাটির নাম ‘ভাষা সৈনিক আমির আহমদ বাইলেন’ দিলেও পৌরসভা থেকে আজো ‘স্বীকৃতি’ মেলেনি।

স্মৃতি জড়িয়ে থাকলেও ইতিহাসে বা কোনো গবেষণায় লেখা হয়নি যশোর ইনস্টিটিউটের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক রবিউল আলমের নাম। ভাষা সৈনিকদের দমনে হুলিয়া জারি হলে নিষিদ্ধ পল্লীর যে সব মেয়েরা পুলিশের কবল থেকে কৌশলে তাদের রক্ষা করেছিলেন তাদের নামও নেই কোথাও। ভাষার টানে প্রথম গর্জে ওঠা যশোরের ভাষা সৈনিকদের নিয়ে সঠিক ইতিহাস লিপিবদ্ধকরণের দাবি জানিয়েছেন ভাষা সৈনিক পরিবারের সন্তান আবদুল কাদের।

তার মতে, ‘যাদের প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা মাতৃভাষা পেয়েছি, তাদের স্মরণ করা আমাদের কর্তব্য। এর ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।’

তাই দুই একটি হল-ভবন ও রাস্তায় ভাষা সৈনিকদের স্মরণীয় করে না রেখে এই আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা উচিত বলে মনে করেন এই প্রজন্মের তরুণেরা।

মিলন রহমান/এআরএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।