যেভাবে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মেয়র মীরু
সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও শাহজাদপুর পৌরসভার মেয়র হালিমুল হক মীরুর বাবার চাকরিস্থল পাবনায় কাটে তার শৈশবকাল। ষাটের দশকে জন্ম মীরু স্কুলজীবন পার করেছেন পাবনায়। সেই সময়ের পাবনা শহরে নকশালদের প্রভাব ও মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল আন্দোলনের মধ্যে পাবনা শহর ছিল এক উত্তল জায়গা।
এই মেজাজটি ধারণ করে এসএসসি পাসের পর বাবার আর্থিক সহায়তার জন্য যোগ দেয় বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) সিগন্যাল কোরের ওয়্যারলেস অপারেটর হিসেবে। সেখানে এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে অশালীন আচরণ ও মারধর করে পালিয়ে চলে আসেন চাকরি থেকে। পরে বিভাগীয় মামলা থেকে গ্রেফতার এড়াতে ১৯৭৮ সালে আত্মগোপন করে চলে আসেন দাদার বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর পৌর সদরের নলুয়ার চরে।
পলাতক জীবনে হাফ ছাড়তে গ্রামের দু-একজন সঙ্গীসহ শাহজাদপুর সদরে প্রবেশ করেন মীরু। সেই সময়ের জাসদ ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এক-আধটু। বিভাগীয় মামলা মিটে গেলে ছাত্র রাজনীতি দেখে সাধ জাগে আবার কলেজে ভর্তি হতে। ১৯৭৯ সালে জাসদ ছাত্র নেতাদের হাত ধরে শাহজাদপুর কলেজে এইসএসসিতে ভর্তি হন। কলেজ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেন নানাভাবে।
১৯৮১ সালে শাহজাদপুর কলেজছাত্র সংসদের নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন তিনি। শাহজাদপুর কলেজে ভিপি থাকাকালে এক ছাত্র আন্দোলন তার উশৃঙ্খলতায় নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলকে নিয়ে যায় ভিন্নখাতে। তৎকালীন কলেজের অধ্যক্ষকে অফিস কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখেন। যার প্রেক্ষিতে কলেজের গভর্নিং বডি তাকে বহিষ্কার করে। নিজেকে বিভিন্ন সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা, জাসদের গণবাহিনীর সদস্য, নানা ধরনের অস্ত্র ব্যবহারকারী বলে ভক্ত সমর্থকদের কাছে সারাক্ষণ মেতে থাকতেন গল্পে।
১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মশাল প্রতীকে নির্বাচনের পর সাধ জাগে মীরুর বড় দলের সংসদ সদস্য হওয়ার। ১৯৯৫ সালে জাসদ থেকে বের হয়ে প্রথমে বিএনপির সাবেক মহাসচিব মান্নান ভূঁইয়ার শ্যালকের মাধ্যমে বিএনপিতে স্থানীয়ভাবে যোগদান করেন। কিন্তু তখনই তিনি তার নমিনেশন প্রদান করা হবে এমন শর্ত জুড়ে দিলে তৎকালীন বিএনপির শাহজাদপুরের সংসদ সদস্য কামরুদ্দিন এহিয়া খান মজলিশ তার নির্বাচনী এলাকায় তাকে বিএনপির কোনো কর্মসূচিতে অংশগ্রহন করতে দেননি।
এসময় মীরু তার দলবল নিয়ে সাঁথিয়ায় বেগম খালেদা জিয়ার জনসভায় মেজর (অব.) মঞ্জুর কাদেরের সঙ্গে যোগদান করার জন্য চেষ্টা করে সেখানেও ব্যর্থ হন। বিএনপিতে যোগদানের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সুগন্ধায়ও দুইবার গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। এরপর স্থান নেন আওয়ামী লীগে।
১৯৯৫ সালে আওয়ামী লীগে যোগদানের পর ৯৬ সালে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে কাজ করার দায়ে আওয়ামী লীগ থেকে প্রথমবারের মতো বহিষ্কার হন। আবারো দলীয় শৃঙ্খলা ভঙের জন্য ২০০৪ সালে দ্বিতীয় বার আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হন। এরপর থেকেই একলা চলো পথে অস্ত্রের ঝনঝনানি, কথায় কথায় অস্ত্রের ভয় দেখানো হয়ে দাঁড়ায় তার নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা।
২০১৫ সালের তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ না থাকায় পৌর নির্বাচনে উপজেলা ও জেলা থেকে মীরুকে বাদ দিয়ে দলীয় মেয়র প্রার্থী হিসেবে সাবেক ভিপি আব্দুর রহিমের নাম প্রস্তাব করলেও কেন্দ্রে তদবির করে মনোনায়ন নিয়ে আসেন মীরু।
নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর তিনি পাবনার চর থেকে নিষিদ্ধ সংগঠনের বেশকিছু সশস্ত্র সন্ত্রাসী ভাড়া করে এনে বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র ও বোমার ঝঙ্কারে আতঙ্কিত করে তোলে শাহজাদপুরের নির্বাচনী মাঠ।
পৌরসভা নির্বাচনে তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন। ওই সময় মীরু ও তার ভাই পিন্টু ও মিন্টু বহিরাগত সন্ত্রাসী নিয়ে পৌর এলাকার মধ্যে ভোট সন্ত্রাস চালিয়েছিলেন। তার সন্ত্রাসী বাহিনী সাবেক মেয়র নজরুল ইসলাম ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আব্দুর রহিমের নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর ও সমর্থকদের মারধর করেছিলেন। ওই সময়ে শাহজাদপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মাহবুব ওয়াহিদ কাজল হামলার শিকার হয়েছিলেন।
নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে দলীয় কোনো নেতাকর্মীর সঙ্গেই সখ্য না রেখে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের প্রহরায় চলাফেরা করতেন মেয়র হালিমুল হক মীরু। এমনকি পৌরসভা পরিচালনার ক্ষেত্রেও সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী কায়দায় কোনো কাউন্সিলর বা পৌর কর্মকর্তাদের গুরুত্ব না দিয়ে সে এবং তার ভাই পিন্টু-মিন্টুর নির্দেশে চালাতেন পৌরসভা।
ভয়ে তটস্থ থাকতো অসহায় পৌর কাউন্সিলরা। প্রকৌশলী বিভাগের জন্য কেনা একটি মোটরসাইকেল ৯ মাস যাবৎ কেনার পর থেকেই সেটি তার ভাই পিন্টুর ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পৌরসভার বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের প্রথম পর্বের অর্থে ৩৫ লাখ টাকার সংস্কার কাজ গোপনে টেন্ডার দিয়ে ফেয়ার ট্রেডার্স নাম দিয়ে পিন্টুই এক রকম কাজ না করেই বিল উত্তোলন করে।
স্থানীয়রা জানান, পিন্টুর ভয়ে একদিনের জন্যও প্রকল্পস্থলে যায়নি প্রকৌশলী বিভাগের কেউ। পৌরসভার দায়িত্ব গ্রহণের পরে ইউজিআইআইপির প্রকল্পের সাড়ে ১০ কোটি টাকার কাজের টেন্ডারে নিম্ন দরদাতা ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশে তাদের কাছ থেকে ১৩% ঊর্ধ্ব দর দেয়ার আশ্বাস দিয়ে ১০% কমিশন গ্রহণ করে। যার পরিমাণ এক কোটি ১০ লাখ টাকার ওপর। শহরের ৮ কিলোমিটার ড্রেন পরিচ্ছন্নের অভাবে যত্রতত্র অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ড্রেনগুলো।
টেন্ডার দেয়াই যেন তার মূল লক্ষ্য। অসহনীয় অনিয়মের প্রতিবাদ করতে চাইলে তাকে বলতে শোনা যেতো, ‘পৌর নিয়মে নয়-অস্ত্রের নিয়মেই চলবে পৌরসভা।’
যার সর্বশেষ প্রমাণ শাহজাদপুর কলেজ শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি বিজয় মাহমুদ। পৌরসভার নিম্নমানের কাজের প্রতিবাদ করাই ছিল বিজয়ের অপরাধ। এরই জেরে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে মেয়রের ভাই পিন্টু ও মেয়র তার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী দিয়ে বিজয়কে ধরে এনে তার বাড়ির ভেতরের টর্চার সেলে হত্যার উদ্দেশ্যে মারপিট করে হাত-পা ভেঙে ভ্যানে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
বর্তমানে বিজয় রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার অবস্থা এখনও শংকটাপন্ন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সংঘর্ষের সূত্রপাত। সেই সংঘর্ষের সময় পৌর মেয়র ও তার সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ছবি তুলতে গেলে পরিকল্পিতভাবে দৈনিক সমকালের শাহজাদপুর প্রতিনিধি আব্দুল হাকিম শিমুলকে গুলি করে হত্যা করেন পৌর মেয়র হালিমুল হক মীরু ও তার সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী।
এআরএ/জেআইএম