ট্রেনে পণ্য পরিবহনে ব্যবসায়ীদের অনীহা


প্রকাশিত: ০৫:৪৭ এএম, ০৭ জানুয়ারি ২০১৭

পশ্চিমাঞ্চল রেলের সবগুলো রুটের আন্তঃনগর ও মেইল ট্রেনগুলোয় পণ্য পরিবহনের সুযোগ রয়েছে। তবে ট্রেনে কৃষিপণ্য পরিবহনে আগ্রহ নেই ব্যবসায়ীদের। ফলে গুরুত্বপূর্ণ রাজশাহী-ঢাকা রুটেও লাগেজ ভ্যান থাকছে ফাঁকা।

রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, রেলে ইচ্ছেমত পণ্য লোড আনলোডের সুবিধা নেই। এতেই পণ্য পরিবহনে পিছিয়ে পড়ছে রেল। তবে ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্যের একটি বড় অংশ পরিবহন হচ্ছে ট্রেনে। এ খাতে রাজস্ব আয়ের সিংহভাগই আসছে আমদানি পণ্য পরিবহনে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, গত ২৯ অক্টোবর থেকে রাজশাহী-ঢাকা রুটে চলাচলকারী আন্তঃনগর পদ্মা, সিল্কসিটি ও ধুমকেতু এক্সপ্রেস ট্রেনে যুক্ত হয়েছে লাগেজ ভ্যান। ভারত ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানিকৃত লাল-সবুজ ট্রেনে এতোদিন পার্সেল পরিবহনের সুযোগ ছিল না। লাগেজ ভ্যান যুক্ত হয়েছে নীলসাগর ও সুন্দরবন এক্সপ্রেসেও। প্রারম্ভিক স্টেশন থেকে গন্তব্য পর্যন্ত এতে পণ্য পরিবহন সুবিধা মিলছে। অন্য দুটি ট্রেনে কিছুটা পার্সেল মিললেও ফাঁকা যাচ্ছে পদ্মা, সিল্কসিটি ও ধুমকেতু এক্সপ্রেসের লাগেজ ভ্যান। পণ্য নেই এ রুটের মেইল ও লোকাল ট্রেনগুলোতেও।  

যদিও শুরু থেকেই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের রেলে পণ্য পরিবহনে উদ্বুদ্ধ করছে রেল কর্তৃপক্ষ। শুধুমাত্র হরতাল-অবরোধের দিনগুলোয় সামান্য কিছু পণ্য রেলে পরিবহন হলেও অন্য দিন গুলোতে মিলছে না সাড়া।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, রেলপথে পণ্য পরিবহন তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। কিন্তু সড়ক পথের চেয়ে সুলভ নয়। রাজশাহী অঞ্চল থেকে মূলত কৃষি পণ্য ও তাজা মাছ ঢাকায় নেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু তাজা মাছ পরিবহনে পানি পড়ার ঝামেলা থাকায় তা নিতে রাজি নয় রেল কর্তৃপক্ষ। এছাড়া সবজি নিতেও সব চেয়ে বড় সমস্যা গন্তব্য কারওয়ান বাজারে নেয়া।

ট্রেনগুলো গিয়ে কমলাপুর স্টেশনে থামায় নতুন করে যানবাহনে তুলতে হয় সেগুলো। সবমিলিয়ে পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। আর অনেক রুটে ডবল লাইন নেই। নেই আলাদা পার্সেল ট্রেন। ফলে পণ্য পরিবহনে সময় লাগে সড়ক পথের মতই। এতে আগ্রহ নেই বললেই চলে। সড়ক পথে পরিবহন ব্যয় বাড়লেও বিকল্প না থাকায় তাতেই থাকতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।

রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের এক নম্বর প্লাটফর্মের পূর্বপ্রান্তে  পার্সেল বুকিং কাউন্টার। গতকাল সেখানে গিয়ে দেখা যায়, অলস বসে রয়েছেন ১০জন কুলি। পাশেই রাখা পাঁচটি বস্তা, কয়েকটি ক্যারাম বোর্ড, কিছু কার্টন। নেই পণ্যের উঠানামা।
সেখানে কথা হয় পৌঢ় কুলি আব্দুস সোবাহানের সঙ্গে।

তিনি জানালেন, ৪০ বছর ধরে স্টেশনে পণ্য ওঠা-নামার কাজ করছেন তিনি। এখন রাজশাহী থেকে কোথাও তেমন পণ্য যায় না, আসেও না। হাতে গোনা ২০ থেকে ৩০টা কার্টন এবং ১০টার মত বস্তা আসে যায়। সবাই মিলে হাত লাগান তাতে। সব মিলিয়ে প্রতিদিন একেক জন আয় করেন সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা করে। তাও আবার ৪০ জন কুলি পালাক্রমে দুই শিফটে কাজ করেন এখানে। কাজ না থাকায় আয়ও কমেছে।

তার ভাষায়, একযুগ আগেও রাজশাহী থেকে বিপুল পরিমাণ পান ও টমেটো যেতো বিভিন্ন গন্তব্যে। আসতো আলুসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য। তখনকার দিনে অন্তত এক হাজার টাকা করে আয় হতো দিনে। এখন এসবের কিছুই নেই।

পার্সেল কাউন্টারের বারান্দায় টেবিলে বসে লেখালিখি করছিলেন একজন। সামনেই রাজনৈতিক পরিচয়ে টাঙানো পার্সেল সহকারী আকতার আলীর পোস্টার। নিজেকে কুলি সর্দার পরিচয় দেয়া ওই ব্যক্তি জানালেন, আকতার আলী অফিসে নেই। তিনজন পার্সেল সহকারীর অন্য দুজনও বাইরে। কাজ না থাকায় তারা বেশিরভাগ সময় বাইরে বাইরেই থাকেন।

পরে পশ্চিমাঞ্চল রেলের অতিরিক্ত প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপকের দফতরে গিয়ে পাওয়া গেলো পার্সেল সহকারী হাসিবুল হাসান সিদ্দিককে। তিনি জানান, রেলে পণ্য পরিবহন ভাড়া আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। বর্তমানে প্রতিকেজি সাধারণ পণ্য নিতে ২ টাকা ৩৫ পয়সা এবং ইলেট্রনিক্স গুডস নিতে ৩ টাকা ২০ পয়সা হারে ভাড়া নেয়া হয়। মূলত বাসাবাড়ি বদল করছেন এমন লোকজনই এ রুটে পণ্য বহন করছেন।

এছাড়া রাজশাহী-খুলনা, রাজশাহী-চিলাহাটি এবং রাজশাহী-গোয়ালন্দ রুটে কিছু কৃষিপণ্যসহ অন্যান্য মালামাল পরিবহন হয়। এসব রুটে ভাড়া প্রায় কাছাকাছি। তবে মোটরসাইকেল বহনে সব রুটেই ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা। এ হিসেবে ঢাকায় একটি মোটরসাইকেল নিতে খরচ হয় ৫ হাজার ৬১ টাকা। যদিও বেসরকারি পরিবহনে তা নিতে তিন হাজারের নিচে খরচ হয়।

এ বিষয়ে রাজশাহী নগরীর অন্যতম মোটরসাইকেল বিক্রেতা কেআর বাইক সেন্টারের সত্ত্বাধিকারী আবু হুসাইন সিদ্দিকী বলেন, এখন বিভিন্ন কোম্পানি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় শো-রুমে বাইক পৌঁছে দিচ্ছে। আগে তারা নিজেরাই ঢাকা থেকে বাইক আনতেন। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি বাইক পরিবহনে খরচ হতো এক হাজার টাকা করে। এক সঙ্গে অনেকগুলো বাইক আনলে খরচ আরও কমে যেতো।

তবে পশ্চিমাঞ্চল রেলের প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক মিহির কান্তি গুহ জানান, গত ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে পুরো অঞ্চলে আয় হয়েছে ২৮৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১৮৪ কোটি টাকা আয় হয়েছে কেবল যাত্রী পরিবহনে। আর বিভিন্ন পণ্য পরিবহনে আয় হয়েছে ৮৪ কোটি টাকা ৬৫। বাকি ৭ কোটি টাকা আয় হয়েছে পার্সেল পরিবহনে। চলতি ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে যাত্রী পরিবহনে আয় লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৪৭ কোটি টাকা।

এছাড়া পার্সেলে ২১ কোটি ৫ লাখ এবং পণ্য পরিবহনে ৮৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর আগে গত ২০১৩-২০১৪ অর্থ বছরে যাত্রী পরিবহনে আয় হয় ১৮১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। আর পার্সেল পরিবহনে ৭ কোটি এক লাখ এবং পণ্য পরিবহনে ৬৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা আয় হয়। প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণ আয় বাড়ছে। পণ্য পরিবহনের আয়ের সিংহভাগ আসছে ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্য পরিবহনে। কৃষিপণ্য বহন প্রায় শূন্যের কাছাকাছি বলে স্বীকার করেন তিনি।

রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মনিরুজ্জামান জানান, রাজশাহী থেকে তারা কৃষিপণ্য পরিবহনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। এ নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন দফতরেও যোগাযোগ করা হয়েছে। এছাড়া রাজশাহীতে কন্টিনার স্টেশন স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে বিভিন্ন  ধরনের ফলমূল ও কাঁচা শাকসবজি সরাসরি ঢাকায় সরবরাহ সম্ভব হবে।
 
আরএআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।