রংপুরে ফেলুদার ভূমিকায় সুলতানা পারভীন


প্রকাশিত: ১২:৪৫ পিএম, ২৯ নভেম্বর ২০১৬

সত্যজিত রায় সৃষ্ট বাংলা সাহিত্যের একটি জনপ্রিয় কাল্পনিক চরিত্র ‘ফেলুদা’। অনেকেই এই ফেলুদাকে টিভির পর্দায় দেখেছি। বইয়ে পড়েছি ফেলুদার গোয়েন্দাগিরির কথা।

নির্ভুল যুক্তিসঙ্গত কার্যকারণ অনুধাবনের মধ্য দিয়ে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে দিয়েছেন তিনি। আর স্কটিশ লেখক ও চিকিৎসক স্যার আর্থার কোনান ডয়েল এর ‘শার্লক হোমস’। যিনি একজন উচ্চ মেধাসম্পন্ন লন্ডনভিত্তিক ‘পরামর্শদাতা গোয়েন্দা’। যে কোনো প্রকার ছদ্মবেশ ধারণ এবং ফরেনসিক বিজ্ঞানে দক্ষতাবলে জটিল আইনি মামলার নিষ্পত্তি করার জন্য তার খ্যাতি ভুবনজোড়া।

শার্লক হোমস কিংবা ফেলুদাকে শুধু বই আর টিভির পর্দায় সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবিক জীবনেও প্রতিফলন ঘটানোর সাহসিকতা দেখিয়েছেন তেমনি একজন রংপুরের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক সুলতানা পারভীন।

প্রশাসনের একজন উচ্চ পদস্ত কর্মকর্তা হয়ে পারতেন পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর সাহায্য নিতে। কিন্তু সেটা তিনি করেননি।  নিজের বিচক্ষণতা, বুদ্ধি আর সাহসিকতা কাজে লাগিয়ে Mission Impossible কে  Mission possible করেছেন।

সম্প্রতি তিনি তার ফেসবুক পেজে Mission Impossible নামে একটি স্ট্যাটাস দেন। যেখানে চল্লিশ জনেরও বেশি পাঠক তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এ ধরনের সাহসী ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন, এগিয়ে চলার সাহস যুগিয়েছেন কেউ কেউ।

Mahmudul Hasan লিখেছেন, আপনার মতো অফিসার পুলিশ ক্যাডারে থাকলে অনেক ভালো হতো।

Monzum Pintu লিখেছেন, সত্যিই আপনি প্রশংসার দাবিদার। আপনার সাহস ও বিচক্ষণতাকে স্যালুট জানাই।

Shafayat Mahbub লিখেছেন, একেই বলে, পড়বি তো পড় মালীর ঘাড়ে।

নিজের অফিস কক্ষ থেকে চুরি হওয়া ল্যাপটপ উদ্ধারে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘণ্টা ইউনিয়নে পরিচালিত অভিযান সংক্রান্ত বিষয়ে ২৪ নভেম্বর সুলতানা পরভীন তার ফেসবুকে লিখেছেন, গত ০২ নভেম্বর আমার অফিস কক্ষ থেকে টেবিলে রাখা অফিসিয়াল ল্যাপটপটি চুরি হয়ে যায়।

ওই সময় আমি জেলাধীন একটি উপজেলায় সরকারি দায়িত্ব পালনে গিয়েছিলাম। আমাদের অফিসগুলোতে অফিস সহায়ক হিসেবে যারা স্যারদের সঙ্গে দায়িত্ব পালনে থাকে তারা স্যার অফিসে না থাকলে যেন আর কোনো দায়িত্ব নেই এমন ভাবনায় রাজ্যের অলস সময় কাটায়। আর এ সুযোগটিই নিল মাদকের টাকা জোগাতে উম্মত্ত এক চোর।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে চুরি! বিষয়টি মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তথ্য অনুসন্ধানে নেমে পড়লাম। মিললো বেশ কয়েকটি সূত্র। মিললো সন্দেহভাজন চোরের ঠিকানাও। রহস্য উদঘাটনের উত্তেজনা প্রশমন করতে সিদ্ধান্ত নিলাম গভীর রাতে সন্দেহভাজনের বাড়িতে হানা দেবো।

ঘটনা বিস্তারিত জানিয়ে অনুমতি প্রার্থনা করলাম বিচক্ষণ অভিভাবক, সম্মানিত জেলা প্রশাসক মহোদয়ের। জুনিয়র সহকর্মীদের প্রতি স্নেহপরায়ন স্যার বললেন এই Mission Impossible এ রাতে যাওয়া নিরাপদ হবেনা।

নাছোড়বান্দা হওয়ায় অবশেষে একজন ম্যাজিস্ট্রেট, সংশ্লিষ্ট ইউএনও ও ইউপি চেয়ারম্যানকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।

ঘড়ির কাঁটায় রাত ১১টা। সদলবলে উপস্থিত হলাম সন্দেহভাজনের বাড়ি। কিন্তু হায়! সকল উত্তেজনা-উৎকণ্ঠঅ পরিণত হলো হতাশায়। বাড়ির দরজায় ঝুলছে তালা। কোথাও কেউ নেই।

বাড়ন্ত হতাশার সাথে আগ্রহেরও কমতি হয় না। কৌতূহলী হয়ে তালা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নেই। যেই কথা সেই কাজ। ভাঙ্গা হলো তালা। ভাঙ্গা হলো উৎকন্ঠার দেয়াল। সেই সাথে দৃঢ় হলো একটি বিশ্বাস-চুরি করে অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়।

জায়া-পুত্র-পরিবারহীন মাদকাসক্ত চোরের ঘরে মিললো চৌর্যবৃত্তের ৬ জোড়া নতুন দামি জুতা আর কিছু মানিব্যাগ। না কোনো আহার্য-না কোন ব্যবহার্য।
 
যা হোক চোর পেলাম না ঠিকই, কিন্তু হতাশ হবার পাত্র আমি নই। প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করলাম। জানলাম সবাই এই চোরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। তাদের অনুভূতি শুনে মনে হলো যেন এ ধরনের মাদকাসক্ত পেশাদার চোরের বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু-ই বরং কাম্য। সন্দেহ ঘনীভূত হলো। সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দিলাম যেকোনো উপায়ে ল্যাপটপটি খুঁজে বের করার। কারণ সেখানে আমার অনেক জরুরী অফিসিয়াল ডকুমেন্ট ছিল।

রাতে চোরের বাসায় হানা দেয়ায় তার সহচররা যথারীতি সংবাদ পৌঁছে দেয়ায় চোর আর বাসায় ফিরে না। গোয়েন্দাবৃত্তির কাজে আমার শাখার কয়েকজন সহকর্মীকে দায়িত্ব দিয়ে রাখি।

অবশেষে অনেক চেষ্টার পর ইউপি চেয়ারম্যান সাহেব চোরের সহচরদের মাধ্যমে মোবাইল ফোনে চোরের সঙ্গে কথা বলতে সক্ষম হন।

চোর ফোনে কান্নাকাটি ও যথারীতি মিথ্যাচার করে অস্বীকার করার চেষ্টা করলে চেয়ারম্যান সাহেব আমার শেখানো কথামতো তাকে বলেন, তোমাকে ডিসি অফিসের সিসি ক্যামেরায় দেখা গেছে।

নিরূপায় হয়ে চোরের ফোনে স্বীকারোক্তি। সে জানায় ল্যাপটপটি বিক্রি হয়ে গেছে। চোরের স্বীকারোক্তি মতে যে দোকানে বিক্রি হয় সেখানে হানা দেই। প্রথমে যথারীতি অস্বীকার ও পরে স্বীকারের পর্বসমূহ চলতে থাকে।

হাত বদলের ঘটনাও বেড়ে চলে। প্রতিটি হাতই সনাক্তকরণের কাজও এগিয়ে চলে সমান গতিতে। উপায়ান্তর না দেখে ল্যাপটপ ফেরত দিতে ৩ দিন সময় প্রার্থনা করে চোর ও তার চক্র। সবশেষে ৭ দিনের মধ্যে তৃতীয় হাত থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হলো আমার অফিসিয়াল ল্যাপটপটি।

বর্ণনার শেষে গোয়েন্দাদের সূত্র টেনে তিনি লিখেছেন, শার্লক হোমস পড়েছি, ফেলুদা পড়েছি। কিন্তু একদিন নিজেই তাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হব তা কল্পনায়ও ভাবিনি। নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।

ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের যাদের আন্তরিক সহযোগিতায় Mission Impossible কে  Mission possible করেছি।

এ ঘটনায় বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়েছে যে, হাল ছেড়ে না দিয়ে প্রকৃত অনুসন্ধিৎসু হলে Mission Impossible হতে পারে possible।

জিতু/এমএএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।