এখনো খোলা আকাশের নিচে গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালরা


প্রকাশিত: ০৯:৩৯ এএম, ১৩ নভেম্বর ২০১৬

রংপুর চিনিকলের আওতাধীন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ খামার এলাকার জমিতে সাঁওতালদের উপর পুলিশ ও চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীদের হামলার ঘটনায় প্রাণ ভয়ে এলাকা ছেড়েছেন সাঁওতালরা। তারা স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সাপমারা ইউনিয়নের মাদারপুর ও জয়পুরপাড়ার সাঁওতাল পল্লিতে আশ্রয় নিয়েছেন।

কিন্তু ঘটনার আটদিন অতিবাহিত হলেও মাদারপুর ও জয়পুরপাড়ার সাঁওতালদের জীবনযাত্রা চরমভাবে স্থবির হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে নিঃস্ব এসব মানুষ ভয়, আতঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন তারা। অনেকে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

Gaibandha

এছাড়া ঘটনার পর থেকে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষরা বাইরের কোনো কাজে যেতে পারছেন না। কাজ না থাকায় তারা অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছেন।দেখা দিয়েছে খাদ্যর অভাব। পুলিশের গ্রেফতার, আর স্থানীয় প্রভাবশালীদের হুমকিতে সাঁওতাল পরিবারের লোকজন হাট-বাজারেও যেতে পারছেন না। তাছাড়া সাঁওতাল সম্প্রদায়ের অনেক শিশু-কিশোর গত ১০দিন ধরে স্কুলেও যেতে পারছে না বলে অভিযোগ সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজনের।

সাঁওতাল অধ্যুষিত মাদারপুর গ্রামের অনন্ত কিসকু সাহেবগঞ্জ ফার্ম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় যথারিতি চললেও সেখানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম। প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসছে না।

পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী অনন্ত জানায়, মারামারি ও বাড়িতে আগুন দেয়ার পর থেকে ভয়ে স্কুলে যায় না। অপর শিক্ষার্থী প্রভাতী কিসকু, চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী স্মৃতি মুরমুও একই কথা জানায়।

Gaibandha

সাঁওতালদের উচ্ছেদ করার পর রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ ওই স্থানে আখ রোপণ ও চারপাশে তার কাঁটার বেড়া দিয়েছে।

এদিকে, সংঘর্ষের পর এ পর্যন্ত তিনজন সাঁওতাল মারা গেছেন বলে দাবি করছেন তাদের পরিবারের লোকজন। কিন্তু পুলিশের পক্ষ থেকে দুইজন নিহতের কথা স্বীকার করা হয়েছে। তবে এ নিয়ে রোববার  দুপুর পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা হয়নি। নিহত সাঁওতালরা হলেন- দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলার চান্দুপর গ্রামের মৃত জ্যেঠা মাদ্রির ছেলে মঙ্গল মাদ্রি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শ্যামল হেমভ্রম ও সাপমারা ইউনিয়নের শিন্টাজুরি গ্রামের মৃত শম টুটু ওরফে শম মাঝির ছেলে রোমেশ টুটু।

সাঁওতাল সম্প্রদায়ের জমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহ-সভাপতি ফিলিমন বাস্কে জানান, সাঁওতালদের উচ্ছেদের ঘটনায় এখনো আতঙ্ক কাটেনি। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের জীবন যাত্রা বেশ ব্যহত হচ্ছে। ভয়, আতঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতায় অনেকে হাট-বাজারে যেতে পারছে না। এছাড়া শিশু-কিশোরেরাও স্কুলে যেতে পারছে না। এসব ঘটনায় এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। তাছাড়া ঘটনার পর থেকে আরও কয়েকজন সাঁওতালকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।  

রোববার সকালে সরেজমিনে মাদারপুর ও জয়পুরপাড়ার সাঁওতাল পল্লিতে দেখা যায়, সাঁওতাল সম্প্রদায়ের নারী-শিশুদের মধ্যে আতঙ্ক কাটেনি। তারা অনেকে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন।

Gaibandha

রুমিলা কিসকুর বলেন, সামান্য কৃষি কাজ করে সংসার চলে। একচালা ঘর ভেঙে আগুন দেয়া হয়। এখন অনেক কষ্টে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছি।

সুভাস বলেন, খামারের জমিতে ঘর ছিল। সেই ঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়ায় সব শেষ হয়ে গেছে। এখন আর মাথা গোজার  ঠাঁই নেই। কাজের জন্য বাইরেও যেতে পারছি না। তাই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হচ্ছে।

এছাড়া তেরেজা মুরমু মিকাই মুরমু জানান, বসবাসের ঘর, সম্পদ যা ছিল সব আগুনে শেষ হয়ে গেছে। এখন ভয়, আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতায় আছি। তারপরে এখন ঘরে খাবার না থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছি।

রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপক আব্দুল আউয়াল বলেন, চিনিকলের দখলমুক্ত জমি চারদিক ঘিরে ফেলা হয়েছে। এসব জমিতে এখন আখচাষ করা হবে।

গোবিন্দগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুব্রত কুমার সরকার  বলেন, সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজনের উপর যাতে কোনো হামলার ঘটনা না ঘটে সেজন্য সাঁওতাল পল্লিতে পুলিশের নজরদারী রয়েছে।

গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আবদুল হান্নান বলেন, সাঁওতাল পরিবারের লোকজন কর্মহীন থাকায় তারা নিরাপত্তহীনতায় ভুগছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য, সরকারি ও বেসরকারিভাবে তাদের সাহায্যে করা হচ্ছে। এছাড়াও তাদের পুনর্বাসন ও আরও সহযোগিতা দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
 
এর আগে গত রোববার পুলিশ পাহারায় রংপুর চিনিকলের কর্মচারী-শ্রমিক এসব জমিতে আখ কাটতে গেলে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে সাঁওতালদের ছোড়া তীরবিদ্ধ হয়ে ৯ পুলিশ আহত হয়। এছাড়া কয়েক দফায় সংঘর্ষে সাঁওতাল ও চিনিকলের প্রায় ৩০ জন শ্রমিক-কর্মচারী আহত হয়। পরে এ ঘটনায় গোবিন্দগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) কল্যাণ চন্দ্র বাদী হয়ে ৩৮ জন নামীয় ও অজ্ঞাত ৩০০ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় পুলিশ এ পর্যন্ত দীজেন টুটু, চরণ সরেন, বিমল কিশকু ও মাঝিয়া হেমভ্রম নামে চার সাঁওতালকে গ্রেফতার করেছে।

প্রসঙ্গত, রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ ১৯৬২ সালে আখ চাষের জন্য গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ (বাগদা-কাটা) এলাকায় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ১৮৪২ একর জমি অধিগ্রহণ করে। এসব জমি বাপ-দাদার দাবি করে আন্দোলনে নামে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তারা গত ১ জুলাই এই খামারের প্রায় ১০০ একর আবাদী জমিতে ছোট ছোট কুড়ে ঘর নির্মাণ করে বসবাস করে আসছিলো।

জিল্লুর রহমান পলাশ/আরএআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।