৩৪ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি জয়পুরহাট চুনাপাথর প্রকল্প


প্রকাশিত: ০৬:১৮ এএম, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

অর্থনৈতিক সমীক্ষা ও তহবিলের অভাবে জয়পুরহাট চুনাপাথর প্রকল্পটি ৩৪ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি। বাংলাদেশ মিনারেল এক্সপোরেশন ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন ১৯৮১ সালে প্রথম ধাপে প্রকল্পের ২১টি কূপ খনন করে সম্ভাব্যতা যাচাই করে।

এরপর ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় ধাপে শ্যাপ্ট কনস্ট্রাকসনের (উত্তোলন পদ্ধতি) মাধ্যমে প্রতিদিন পাঁচ হাজার ৫০০ টন চুনাপাথর উত্তোলন করা যাবে মর্মে সংস্থাটি প্রতিবেদন দেয়। আর এই পদ্ধতিতে চুনাপাথর উত্তোলনে সে সময় সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১৫৯ কোটি টাকা।

জয়পুরহাটে চুনাপাথর খনি আবিষ্কৃত হয় ১৯৬৩ সালে। ওই খনিতে প্রায় ১০০ মিলিয়ন (১০ লাখে ১ মিলিয়ন) টন চুনাপাথর মজুদ থাকলেও আজ পর্যন্ত এক টনও উত্তোলন করা সম্ভব হয়নি। অথচ চুনাপাথর প্রকল্প রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১৯৮২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করছেন ১৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। প্রতি মাসে তাদের বেতন ভাতা বাবদ ব্যয় হচ্ছে প্রায় আড়াই লাখ টাকা।

Joypurhat

খনি সূত্রে জানা গেছে, চুনাপাথর খনি আবিষ্কারের পর প্রকল্প উন্নয়নের জন্য সে সময় প্রায় ১৪২ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়। পাকিস্থানের ভূতাত্ত্বিক জরিপ (জিওলজিক্যাল সার্ভে) বিভাগ ১৯৬৪ সালে জয়পুরহাট চুনাপাথর প্রকল্পে প্রথম কাজ শুরু করে। সে অনুযায়ী ১৯৬৫ সালে জার্মানির ফ্রাইড ক্রপ রোস্তোফি কোম্পানি প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করে। ওই কোম্পানি ১৯৬৬ সালের নভেম্বরে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করে।

প্রতিবেদনে তারা উল্লেখ করে, জয়পুরহাটের খনিতে চুনাপাথর আছে ৫১৩ থেকে ৫৭০ মিটার গভীরে। এর বিস্তৃতি ৬ দশমিক ৭ বর্গকিলোমিটার জুড়ে। পরবর্তীতে যুক্তরাজ্যের পাওয়েল ডাফরিন কেম্পানিটি প্রযুক্তিগত জরিপ সম্পন্ন করে ১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ১৯৬৯ সালের অক্টোবরে প্রকল্পটি অনুমোদন করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলেও বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে সেই উদ্যোগ থেমে যায়।

দেশ স্বাধীনের পর বছরে এক মিলিয়ন টন চুনাপাথর আহরণ করার জন্য ১৯৭৪ সালে প্রকল্প উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। যার ব্যয়ভার নির্ধারিত হয় প্রায় ৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রার আশ্বাস মিললেও বরাদ্দ না পাওয়ায় থেমে যায় এর সব কার্যক্রম। একই ঘটনা ঘটে ১৯৭৮ সালে।

Joypurhat

প্রকল্প উন্নয়নে নির্ধারিত ১৫৯ কোটি টাকার মধ্যে ১১৯ কোটি টাকা প্রদানের আশ্বাস দেয় সৌদি সরকার। সে মোতাবেক কাজ শুরু হয়। যার ধারাবাহিকতায় ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ মিনারেল এক্সপোরেশন ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (বিএমইডিসি) দুটি ধাপে কাজ শুরু করে।

উন্নয়ন প্রকল্পে প্রথম ধাপে ২০-২১টি কূপ খনন করে খনিতে পুরোপুরি সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। এজন্য ব্যয় হয় ১২ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আর দ্বিতীয় ধাপে শ্যাপ্ট কনস্ট্রাকসনের মাধ্যমে প্রতিদিন সাড়ে ৫ হাজার টন চুনাপাথর উত্তোলনে সার্বিক জরিপ কাজও সম্পন্ন করা হয়।

ওই জরিপে জানা গেছে, প্রকল্পে ভূগর্ভের তাপমাত্রা ৪২ থেকে ৪৪ ডিগ্রি। যেখানে ৫১৫ থেকে ৫৬০ মিটার গভীরতায় চুনাপাথর মজুদ আছে। কিন্তু সার্বিক জরিপ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর সে সময় অজ্ঞাত কারণে সৌদি সরকার তহবিল দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সেই থেকে এর সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

Joypurhat

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জয়পুরহাট চুনাপাথর প্রকল্পে প্রায় ১৪২ একর অধিগ্রহণ করা জমির মধ্যে বর্তমানে আছে প্রায় ৫৯ একর। অবশিষ্ট জমি মহিলা গার্লস ক্যাডেট, ইনস্টিটিউট অব মাইনিং মিনারলজি অ্যান্ড মেটালারজি, কিশোর সংশোধনাগারের জন্য চূড়ান্ত প্রক্রিয়ায় রাখা হয়েছে। জরিপ অনুযায়ী এই ৫৯ একর জায়গার নিচে রয়েছে চুনাপাথর খনি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, খনি থেকে বর্তমানে চুনাপাথর আহরণ করতে হলে আর কোনো জরিপের প্রয়োজন হবে না। শুধু চুনাপাথর আহরণে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দিয়ে অর্থনৈতিক নিরীক্ষার মাধ্যমে সম্ভাব্যতা নির্ধারণ করে এর কাজ শুরু করা সম্ভব। খনি প্রকল্পে ১৩ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটার থেকে ২৬ বছরে ৪৫ মিলিয়ন টন চুনাপাথর আহরণ করা সম্ভব।

এই চুনাপাথর খনি ও সিমেন্ট প্রকল্পের হিসাব সহকারী মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘আশির দশকে খনি উন্নয়নের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে একজন প্রকল্প ব্যবস্থাপকসহ ১৭ জন কর্মচারী এখানে কর্মরত আছেন। প্রতি মাসে তারা নিয়মিত বেতন ভাতা পাচ্ছেন।’

Joypurhat

জয়পুরহাট সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান তিতাস মোস্তফা বলেন, ‘আমরা শুনেছি জয়পুরহাটের খনিতে যে চুনাপাথর রয়েছে সেটা নাকি বিশ্বমানের। কিন্তু খনি উন্নয়নে কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা গৃহীত না হওয়ায় বছরের পর বছর এর অধিগ্রহণ করা জমিগুলো খালি পড়ে আছে। আর আমরা শুধু কাগজে-কলমে শুনে আসছি জয়পুরহাট চুনাপাথর প্রকল্প উন্নয়নের নানা গল্প।’

পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান ও জামালগঞ্জ সিবিএম স্টাডি কয়লাখনি প্রকল্পের পর্যবেক্ষণ পরামর্শক মর্তুজা আহম্মদ ফারুক বলেন, ‘জয়পুরহাটের এই চুনাপাথর বিশ্বের সেরা মানের। এই খনি উন্নয়নে একাধিকবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, প্রতিবার তহবিলের অভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

তিনি আরো বলেন, ১৯৮২ সালে এই খনি উন্নয়নে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৫৮ কোটি টাকা। কিন্তু এখন ওই টাকায় সম্ভব নয়। এখন বিদেশি কোনো বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়ে এর সম্ভাব্য ব্যয় নিরুপণ করতে হবে। কাজ শুরু করা গেলে অল্প সময়ের মধ্যে এই খনি থেকে চুনাপাথর উত্তোলন করা সম্ভব।’

এসএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।