দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মাসুদের দিন বদলের গল্প


প্রকাশিত: ১০:৩০ এএম, ২৮ আগস্ট ২০১৬

সমাজ প্রতিবন্ধীদের বোঝা মনে করলেও, মাসুদের সাফল্য প্রমাণ করেছে ‘প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, উপার্জন অক্ষম ব্যক্তিই সমাজের বোঝা।’ জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়া এ রকম একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মাসুদ রানা।

৩৩ বছরের জীবনে তাকে পোহাতে হয়েছে নানা বিড়ম্বনা। বেঁচে থাকতে জীবনের বড় সময়টুকু ব্যয় করতে হয়েছে জীবন সংগ্রামে। জন্মদাতা বাবা-মা আর স্ত্রী সন্তানের বাঁচার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতেও কম ত্যাগ করতে হয়নি মাসুদকে।

অন্ধত্বের চিকিৎসা করতে এক সময় বাবা-মা আর্থিকভাকে পথে বসেছিল। এখন সেই প্রতিবন্ধীই পুরো সংসারের হাল ধরেছেন। ২০১১ সালে ১৩ শতাংশ জমির ওপর হাজার খানেক মুরগি নিয়ে শুরু করেন খামার।

মাসুদের খামারে এখন প্রায় ২ হাজার ৩০০ লেয়ার মুরগি রয়েছে। এ খামার থেকে বর্তমানে তার মাসিক উপার্জন দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় লাখ টাকা। স্ত্রী, সন্তান, ভাই-বোন, বাবা-মাকে নিয়ে ভালোই চলছে মাসুদের জীবন। তার জীবন সংগ্রামের সাফল্য এখন হার মানিয়েছে একজন স্বাভাবিক মানুষকে।

জেলার দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল ইউনিয়নের মঙ্গলহোড় গ্রামে ১৯৮৩ সালে মাসুদের জন্ম। সাফল্যের কথাগুলো মাসুদ নিজেই শোনালেন। পাশেই ছিল মাসুদের বাবা মো. সামাদ মিয়া। যে বয়সের কথা মাসুদের মনে থাকার কথা নয়, সেই কথাগুলো বললেন মাসুদের বাবা।

সামাদ মিয়ার চার সন্তানের মধ্যে সবার বড় মাসুদ রানা (৩৩)। বাবা-মায়ের আদর কি তা বোঝার আগেই তিন বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বরে মাসুদের দুই চোখ অন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের পক্ষ থেকে সেই সময়ে স্থানীয় চিকিৎসকসহ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা করে লাখ পাঁচেক টাকা খরচ করেও ফেরাতে পারেনি চোখের আলো।

তারপর থেকেই স্থায়ীভাবে অন্ধ হয়ে যান মাসুদ। অন্ধ বলে থেমে থাকেননি তিনি। ১৯৯৩ সালে ১১ বছর বয়সে তিনি টাঙ্গাইল জেলা শহরে বিবেকানন্দ স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হন। লুইবেন হেলেন ক্লারের ব্রেইলি পদ্ধতিতে ১৯৯৯ সালে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে বাড়ি ফিরে আসার পর নিজেকে পরিবারের বোঝা মনে করেন। পরে ওই বছরই বাড়ির পাশে মঙ্গলহোড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে মুদি দোকান দেন। বেচা-কেনা ও টাকা নিতে কোনো সমস্যায় পড়েননি তিনি।

২০০১ সালের শেষ দিকে গাজীপুরের টুঙ্গী প্রতিবন্ধী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বাঁশ-বেতের কাজ শিখতে যান মাসুদ। সেখানেও নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেননি। কিছুদিন কাজ শেখার পর বাড়ি এসে আবার কর্মজীবনে আটকে যান। এরপর থেকে জমা-জমির চাষ থেকে শুরু করে গরু পালন পর্যন্ত বাবাকে সাহায্য করতে থাকেন।

২০০৫ সালে তিনি নাটোরের বরাইগ্রামে রেখা আক্তারকে বিয়ে করেন। মাসুদের স্ত্রী রেখা আক্তার বলেন, তাদের দাম্পত্য জীবন চলছে স্বাভাবিক। চলাফেরা এমনকি উপার্জনের দিক দিয়েও তার স্বামী অন্যদের মতোই। নিজেকে মানিয়েও নিয়েছে অতি সহজে। তার ঘরে জন্ম হয়েছে অর্পা নামে এক কন্যাসন্তানের।

polrty

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মাসুদের মেয়ে অর্পা জানায়, তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ তার বাবা। স্কুলে যাওয়া থেকে টিফিন খাওয়ানো পর্যন্ত সব কাজে বাবা তাকে সহযোগিতা করে। কোনো অভাবই তাকে লাগতে দেননি তার বাবা।

প্রতিবন্ধী হিসেবে দাদা হামিদ মিয়ার কাছ থেকে পাওয়া ১৩ শতাংশ জমির ওপর ২০১১ সালে হাজার খানেক মুরগি নিয়ে তৈরি করে লেয়ার মুরগির খামার। দিন দিন বৃদ্ধি পায় মাসুদের খামারে মুরগি।

এখন তার খামারে প্রায় ২ হাজার ৩০০ লেয়ার মুরগি রয়েছে। প্রথম দুই বছর নিজেই সব কাজ করতেন। বর্তমানে তার খামারে কর্মচারী হিসেবে কাজ করছে নীলফামারী জেলার জিয়াউর রহমান (২৫) নামের এক যুবক। থাকা খাওয়ার পর তাকে মাসিক মাইনে দিতে হয় ৭ হাজার টাকা।

খামারের কর্মচারী জিয়া বলেন, মাসুদ ভাই সব কাজই করতে পারেন। খামার বড় হওয়ার কারণে কর্মচারী লাগছে। এখন স্থানীয় বাজারের ডিমের চাহিদা পূরণ করছে মাসুদের খামার। প্রথম পর্যায়ে বার্ড ফ্লু রোগে মুরগি মারা যাওয়ায় খামারের কিছু লোকসান হলেও বর্তমানে তার মাসিক উপার্জন প্রায় দেড় লাখ টাকা।

খামারে মুরগির খাবার দেয়া, পানি দেয়া, ডিম সংগ্রহ থেকে ডিম বিক্রি করা পর্যন্ত সব কাজই মাসুদ নিজে করছে। ভোর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত টানা কাজ করেও তার আত্মতৃপ্তি সে নিজে উপার্জন করছে। ছোট ভাই সোহেল ও রাসেলের টাকায় প্রথমে খামারটি তৈরি হলেও সংসারে এখন তাদের টাকার প্রয়োজন হয় না। তার উপার্জনেই সংসার চলছে।

এমনকি তার ভগ্নিপতি (সালমার স্বামী) মো. সেলিম মিয়া গত চার বছর আগে হৃদরোগে মারা যাওয়ার পর থেকে সালমার সংসার খরচ বাবদ মাসে ১০ হাজার টাকা করে দিয়ে আসছে। শুধু তাই নয়, প্রতিবেশী বহুলোক মাসুদের কাছে অর্থ সাহায্য নিয়েও চলছে।

এ প্রসঙ্গে মাসুদের বাবা সামাদ মিয়া বলেন, মাসুদকে কখনোই তারা প্রতিবন্ধী মনে করে না। সন্তান হিসেবে মাসুদ অন্য তিন ছেলে মেয়ের মতোই। জীবনযাপনও করছে স্বাভাবিক। সে সংসারের বোঝা নয়। এক সময় মাসুদকে সারিয়ে তুলতে তারা অনেকটাই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এখন মাসুদই সংসারের হাল ধরেছে।

মাসুদের মা মাসুমা বেগম বলেন, যদিও শিশু বয়সে মাসুদ স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু টাইফয়েডের পর থেকে মাসুদের দুটি চোখই স্থায়ীভাবে অন্ধ হয়ে যায়। মায়ের কাছ থেকে যতটুকু আদর স্নেহ পাওয়া দরকার, পরবর্তী তিন সন্তান জন্ম হওয়ায় মাসুদকে ততোটা সময় দিতে পারিনি। তবে ওর জন্য দোয়া রয়েছে।

পাথরাইল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ চান খা বলেন, মাসুদ একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবনযাপন করছে। চলাফেরা বা কাজকর্মে তাকে কখনোই প্রতিবন্ধী মনে হয় না। বরং মাসুদ স্বাভাবিক মানুষের জন্য একটি মডেল। যা অনুসরণ করে একজন স্বাভাবিক মানুষ স্বাবলম্বী হতে পারে।

এসএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।