পাহাড়ে শুরু হচ্ছে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কার্যক্রম
অবশেষে সরকার ভূমি কমিশনের বিদ্যমান আইন সংশোধন করায় পার্বত্যবাসীর মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। শুরু হতে যাচ্ছে পাহাড়ে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কার্যক্রম। এতে সক্রিয় হয়ে উঠছে দীর্ঘদিন ধরে অচল থাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন। সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তিকল্পে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। চলতি মেয়াদেই পর্যায়ক্রমে বিরোধগুলো কমিয়ে আনতে চায় সরকার। ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করা গেলে বিষয়টি ঘিরে পার্বত্য চট্টগ্রামে আর অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটবে না বলে সরকার আশা করছে।
বিষয়টি উপলব্দি করে ১ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত নিয়মিত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভায় ভোটিং সাপেক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন-২০১৬ র খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়। এরপর ৮ আগস্ট রাষ্ট্রপতির সম্মতিক্রমে ৯ আগস্ট সংশোধিত আইনটির ওপর অধ্যাদেশ (নং-০১, ২০১৬) জারি করে সরকার।
এদিকে সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন, ২০১৬ এর অধ্যাদেশ জারিতে বিষয়টি পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এ নিয়ে জনমনে স্বস্তির পাশাপাশি আইনটি কার্যকর হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর কিছু মানুষ ভূমিহারা হয়ে পড়ার আশঙ্কার কথা তুলে সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নেয় স্থানীয় বাঙালিভিত্তিক কতিপয় সংগঠন।
তারা ইতোমধ্যে আইনটি বাতিলের দাবিতে তিনটি পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে গত ১০ ও ১১ আগস্ট সকাল-সন্ধ্যা হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। এছাড়াও দাবিটি জোরালো করতে ১৭-৩০ আগস্ট পর্যন্ত পক্ষকালব্যাপী জনসংযোগ, বিক্ষোভ, প্রতীকী অনশন, স্মারকলিপি প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচির ঘোষণা করেছে স্থানীয় পাঁচ বাঙালি সংগঠন পার্বত্য নাগরিক পরিষদ, পার্বত্য গণপরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম সম-অধিকার আন্দোলন, পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ ও পার্বত্য বাঙালি ছাত্র ঐক্য পরিষদ।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিস্পত্তি কমিশন গঠন করে। কিন্তু বিদ্যমান আইনে নানা জটিলতার কারণে এর আগে কোনো কাজ করতে পারেনি কমিশন। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আনোয়ারুল হক এ কমিশনের চেয়ারম্যান। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাকে কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে সরকার। তার আগে ২০০৯ সালের ১৯ জুলাই অবসরপ্রাপ্ত বচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়। চেয়ারম্যানের মেয়াদ তিন বছর। তবে চেয়ারম্যান না থাকলে কমিশন থাকে অকার্যকর।
বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির (ঘ) খণ্ডের ৪নং ধারা বলে ১৯৯৯ সালের ৩ জুন গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন। ২০০১ সালের ১২ জুলাই জাতীয় সংসদে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি (ল্যান্ড কমিশন) কমিশন আইন-২০০১ পাস হয়। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে এতদিন যাবৎ কমিশনটি ছিল কার্যত: অচল।
ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভূমি নিয়ে বিদ্যমান বিরোধ নিষ্পত্তির পরিবর্তে সমস্যা আরো বাড়তে থাকে। স্পর্শকাতর এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে অতীতে বিভিন্ন সময়ে তিন পার্বত্য জেলার অনেক জায়গায় অনাকাঙ্খিত ঘটনাও ঘটে। তাই বিষয়টি উপলব্ধি করে সরকার কমিশনকে কার্যকর করে তিনটি পার্বত্য জেলায় ভূমি সংক্রান্ত বিরোধগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ভূমি কমিশন আইনের বিরোধাত্মক ও সাংঘর্ষিক ধারাগুলোর সংশোধন করেছে। সরকারের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে শুভ ও সুখকর বলে মন্তব্য করেছেন পাহাড়ি নেতারা।
অপরপক্ষে ভূমিহারা হওয়ার আশঙ্কায় এর বিপক্ষে স্থানীয় কয়েকটি সংগঠন অবস্থান নিলেও আশঙ্কার তেমন কিছুই নেই বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সূচনাতেই উল্লেখ রয়েছে যে, ‘বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি পূর্ণ অবিচল আনুগত্য রাখিয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া তরান্বিত করা এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব স্ব অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তরফ হইতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অধিবাসীদের পক্ষ হইতে পার্বত্য জনসংহতি সমিতি বর্ণিত চারি খণ্ড (ক, খ, গ, ঘ) সম্বলিত চুক্তিতে উপণীত হইলেন....।’ অতএব এক্ষেত্রে পার্বত্য চুক্তির শর্তে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধান) আইন, ২০১৬ এর কারণে এখানকার অধিবাসী কেউ ভূমিহারা বা কারো অধিকার খর্ব হওয়া অথবা পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।
এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন-২০১৬’এর অধ্যাদেশ জারি করায় সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে রাঙামাটির সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার বলেন, সরকারের এ উদ্যোগের ফলে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে আরেক ধাপ এগিয়েছে। এতে করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিরাজমান ভূমি ও ভূমি নিয়ে সমস্যা সমাধান হবে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী সমস্যার সমাধানে শান্তিচুক্তির বাকি অংশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নেও উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে।
এ বিষয়ে আলাপকালে চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, সরকারের এ উদ্যোগটি খুবই ভালো একটি দিক। এটি আরও আগে হওয়া উচিত ছিল। পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনটির সংশোধনী দ্রুত কার্যকর হলে তাড়াতাড়ি পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সম্যসাগুলো সমাধান হতে পারে।
সুশীল প্রসাদ চাকমা/এফএ/এমএস