জীবন বদলে দিয়েছে গোলমরিচ
পর্তুগিজ, ফরাসী ও ইংরেজরা যে কয়টি কারণে অবিভক্ত ভারতবর্ষে আগমণ করেছিল তাদের জন্য মসলা সংগ্রহ একটি। ওই সময়কালে ভারতবর্ষে মসলার উৎপাদন হতো প্রচুর। ইউরোপীয় বণিকরা মসলা সংগ্রহে মূলত ভারতবর্ষ অভিমুখে জাহাজ পাঠাতো। ভারতবর্ষের অন্যান্য এলাকায় প্রচুর মসলার চাষ হলেও বাংলাদেশে সে সময়ে মসলা চাষ হতো না।
আদিকালে বাংলাদেশের মসলার যোগান হতো ভারত থেকে। বর্তমানেও বাংলাদেশে যে মসলা উৎপাদন হয় তা খুবই অপ্রতুল। এখনো ভারত ও পাকিস্তান থেকে বিভিন্ন জাতের মসলা আমদানি করে এ দেশের চাহিদা মেটানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশেও মসলা উৎপাদন করা সম্ভব। সঠিক পরিকল্পনা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন জাতের মসলা দিয়ে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানিও করা সম্ভব এটি প্রমাণ করেছেন হবিগঞ্জের আলীয়াছড়া পান পুঞ্জির বাসিন্দা আদিবাসী খাসিয়ারা।
এ পুঞ্জির প্রায় ২শ খাসিয়া গোলমরিচ চাষে নিজেদের ভাগ্য বদলেছেন। হয়েছেন অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার ভাদেশ্বর ইউনিয়নের মুছাই পাহাড়ে আদিবাসী খাসিয়া পান পুঞ্জি আলীয়াছড়ার অবস্থান।
এ পুঞ্জির বাসিন্দা আদিবাসী খাসিয়ারা তাদের ঐতিহ্যবাহী খাসিয়া পান, সুপারি, লেবু, আনারস চাষে জীবিকা নির্বাহ করতো। কিন্তু বর্তমানে পাল্টে গেছে দৃশ্যপট।
২০০৫ সাল থেকে এ পুঞ্জির বাসিন্দরা নির্ভর করছেন গোলমরিচ চাষে। পুঞ্জির ৬০ একর এলাকা জুড়ে হাজার হাজার গোলমরিচ গাছ। অধিকাংশ খাসিয়া পান চাষি পানের বদলে গোলমরিচ চাষে অধিক পরিমাণে আগ্রহী হয়ে ওঠার ফলে পাল্টে গেছে আলীয়াছড়া খাসিয়া পান পুঞ্জির অর্থনৈতিক অবস্থা।
সরেজমিনে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার আলীয়াছড়া পান পুঞ্জিতে গিয়ে আদিবাসী গোল মরিচ চাষের ব্যাপারে খাসিয়াদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, গোল মরিচের গাছ অনেকটা পান গাছের মতো। পান গাছের মতো গোল মরিচ গাছও অন্য বড় ধরনের গাছকে অবলম্বন করে বেড়ে ওঠে। প্রবল বৃষ্টিপাতের সময় অর্থাৎ আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে গোল মরিচ গাছের চারা রোপনের উপযুক্ত সময়।
চারা রোপনের ৪ বছরের মধ্যে প্রতিটি গোল মরিচ গাছে ফলন আসে। একটি গাছ থেকে মৌসুমে আনুমানিক ৩ কেজি গোল মরিচ উৎপন্ন হয়। সময়মতো গাছ থেকে গোল মরিচ সংগ্রহ করে রোদে শুকিয়ে বাজারজাত করতে হয়। আদিবাসী খাসিয়া পান পুঞ্জি আলীয়াছড়ায় অসংখ্য সুপারি গাছ রয়েছে। এ গাছকে অবলম্বন করেই আদিবাসী চাষিরা গোল মরিচ চাষ করছেন। এতে খরচ ও পরিশ্রম অনেকটা কমে যায়।
পান পুঞ্জির বাসিন্দা গোল মরিচ চাষি অরুন খাসিয়া জানান, তিনি তার ৪ একর জমিতে পানের বিকল্প হিসেবে গোল মরিচ চাষ করেছেন। তার গোল মরিচ গাছগুলোতে ফলন হয়েছে ভালো। মান ভালো হবার কারণে বাজারে মূল্যও পেয়েছের বেশি।
তিনি জানান, তার জমিতে যে পরিমাণ গোল মরিচ উৎপাদন হয়েছে তাতে তিনি যে অর্থ উপার্জন করেছেন পান চাষে ওই সময়ে এতো অর্থ উপার্জন সম্ভব নয়। ফলে ওই খাসিয়া পান পুঞ্জির অধিকাংশ বাসিন্দা পানের বদলে গোল মরিচ চাষে অধিক পরিমাণে আগ্রহী হয়ে ওঠেছেন। আলীয়াছড়া খাসিয়া পুঞ্জিতে এখন গোল মরিচ চাষের বিপ্লব শুরু হয়েছে।
হবিগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আব্দুল বাতিন জানান, হবিগঞ্জের মাটি, পরিবেশ ও আবহাওয়া গোল মরিচ চাষের সম্পূর্ণ উপযোগী। এ অঞ্চলের চাষিরা গোল মরিচসহ অন্যান্য মসলা জাতীয় ফসল উৎপাদন করতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সহায়তা করতে প্রস্তুত।
তিনি জানান, দেশের চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার মসলা বিদেশ থেকে আমদামি করতে হয়। দেশে ব্যাপক ও বাণিজ্যিকভাবে মসলা উৎপাদন করতে পারলে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে না।
এমএএস/এমএস