মৎস্যখাতে অগ্রগতিতে মাইলফলক যশোর
মৎস্য খাতে একের পর এক অগ্রগতিতে মাইলফলক স্থাপন করে চলেছে যশোর জেলা। প্রতি বছর এই জেলায় দুই লক্ষাধিক মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হচ্ছে। জেলার চাহিদা ৬০ হাজার টন মিটিয়ে দেড় লাখ টন সরবরাহ করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়।
জেলার লক্ষাধিক মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাছ চাষ ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত। এসব কিছু মিলিয়ে মাছ উৎপাদনে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে যশোর। যদিও মাছ চাষে চাষিদের বিভিন্ন সমস্যা ও সঙ্কট মোকাবেলা করতে হয়। মৎস্য বিভাগ বলছে, এসব সমস্যা ও সঙ্কট দূর করতে কাজ করছেন তারা। জেলার মৎস্য খাতের উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়েছে।
যশোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, যশোর জেলায় ৬০ হাজার ৯০৭ হেক্টর বদ্ধ পুকুর, বাঁওড় ও উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ চাষ হয়। এই জলাশয়ে সবমিলিয়ে এখন বছরে ২ লাখ ৫ হাজার ৮১০.৩১ মে.টন মাছ উৎপাদন হচ্ছে।
জেলায় এখন প্রতি হেক্টরে সবচেয়ে বেশি হারে কৈ মাছ উৎপাদন হচ্ছে। কৈ মাছ প্রতি হেক্টরে ১৮ দশমিক ৩৪ মে.টন আর সর্বনিম্ন বাগদা চিংড়ি শূন্য দশকি ২০০ মে. টন উৎপাদন হয়। এছাড়াও প্রতি হেক্টরে রুইজাতীয় মাছ ৩ দশমিক ৯৭ মে.টন, পাঙ্গাশ ১৭ দশমিক ১৪ মে.টন, তেলাপিয়া ১৪ দশমিক ২৮ মে.টন, মাগুর ৫ দশমিক ৯৬ মে.টন, শিং ৪ দশমিক ৬১ মে.টন ও গলদা চিংড়ি শূন্য দশমিক ৫৪০ মে.টন উৎপাদন হয়।
যশোরের আট উপজেলায় ২৭ লাখ ৬৪ হাজার ৫৪৭ জন মানুষের জন্য বছরে ৬০ হাজার ৫৪৩ দশমিক ৫৭ মে.টন মাছের (মাথাপিছু ৬০ গ্রাম প্রতিদিন) চাহিদা রয়েছে। ফলে উৎপাদন ২ লাখ ৫ হাজার ৮১০.৩১ মে.টন মাছের মধ্যে থেকে চাহিদা মিটিয়ে এ জেলায় উদ্বৃত্ত থাকে ১ লাখ ৪৫ হাজার ২৬৬ দশমিক ৭৪ মে.টন। উদ্বৃত্ত এই মাছ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়। এই মাছ উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত জেলার ১ লাখ ২ হাজার ৫০০ মাছ চাষি, হ্যাচারি মালিক ও মৎস্যজীবী।
এ প্রসঙ্গে জেলা মৎস্য বিষয়ক কর্মকর্তা রমজান আলী জানান, যশোরে মাছ চাষে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সম্ভাবনা কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি আমরা। এ ক্ষেত্রে সফলও হচ্ছি। যশোর শুধু মাছের চাহিদা পূরণে স্বয়ংসম্পন্ন নয়, প্রায় দেড় লাখ টন উদ্বৃত্ত রয়েছে। উদ্বৃত্ত মাছ জেলা ও দেশের বাইরে রফতানি হচ্ছে। মাছের চাহিদা পূরণে যশোর জেলা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। মাছ চাষি, খামারি মালিক ও মৎসজীবীর অক্লান্ত পরিশ্রমে মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পন্নতা অর্জন সম্ভব হয়েছে।
তবে মাছ চাষে ব্যাপক সম্ভাবনা ও অর্জন থাকলেও প্রতিবন্ধকতাও আছে অনেক। এগুলো নিয়ে মৎস্য চাষি ও ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরেই কথা বলে যাচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে যশোর জেলা হ্যাচারি মালিক সমিতির সভাপতি আলহাজ ফিরোজ খান জানান, মৎস্য চাষি খামারিদের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে বড় সমস্যাগুলো হচ্ছে, মৎস্য খাতে উচ্চহারে বিদ্যুৎবিল দিতে হচ্ছে। আমরা কৃষির জন্য নির্ধারিত হারে বিদ্যুৎবিল নেয়ার দাবি জানিয়ে আসছি দীর্ঘদিন ধরে। ভূমি করও নেয়া হচ্ছে বাণিজ্যিক হারে। এছাড়া যশোরের মৎস্য গবেষণা সাব স্টেশনটি এ সেক্টরে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এখানে পূর্ণাঙ্গ স্টেশন দরকার। আর মানসম্মত খাবার ও দাম নিয়েও মাছ চাষিরা রয়েছেন বিপাকে। গুণগত মান নিয়ে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হলেও মান নির্ণয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয় না। তবে মাছ বিক্রয় কেন্দ্রের দীর্ঘদিনের যে সমস্যা রয়েছে, তা দূর হতে চলেছে। চাঁচড়া এলাকায় ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে মৎস্য বিক্রয় কেন্দ্র নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে।
সমস্যা সঙ্কটের কথা স্বীকার করেছেন জেলা মৎস্য বিষয়ক কর্মকর্তা রমজান আলীও। তিনি জানান, সম্ভাবনার মাছ চাষে নানা প্রতিবন্ধতাও আছে। মাছের খাদ্য উপকরণের দাম বেশি, মাছ বিক্রয় কেন্দ্র নেই। চাষিরা রাস্তার ওপর মাছের হাট বসায়। এতে তাদের নানা সমস্যায় পড়তে হয়। মাছ বিক্রির জন্য নির্দিষ্ট সেল (বিক্রয়) সেন্টার স্থাপনের দাবি ছিল চাষিদের।
চাষিদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চাঁচড়ায় মাছ বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপনে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
বৃহত্তর যশোর জেলা মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক হরেন্দ্রনাথ সরকার জানান, যশোরে অচিরেই মাছ বিক্রয় কেন্দ্র নির্মাণ কাজ শুরু হবে। জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এছাড়াও চার জেলায় আরও ৬টি বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। সেল সেন্টারগুলো তৈরি হলে চাষিরা সহজে ও সুন্দর পরিবেশে মাছ বিক্রি করতে পারবে।
এমএএস/আরআইপি