‘মানসিক বিপর্যয়ে’ পাবনা মানসিক হাসপাতাল

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি পাবনা
প্রকাশিত: ১০:৫৭ এএম, ১০ অক্টোবর ২০২৫
নানা সঙ্কটে ভুগছে পাবনার মানসিক হাসপাতাল

চিকিৎসক-জনবলসহ নানা সঙ্কটে ভুগছে পাবনার মানসিক হাসপাতাল। নেই পর্যাপ্ত অবকাঠামো, খাবার, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম। নিরাপত্তা কাজে নিয়োজিত আনসার সদস্যদের টাকা দিলেই মিলছে ভেতরে প্রবেশের গ্রিনকার্ড। ফলে সহজে ভেতরে ঢুকে রোগীদের উত্ত্যক্ত ও মানসিকভাবে হেনস্থাসহ নানা অপরাধ দিনদিন বেড়ে চলছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৫৭ সালে মানসিক রোগের বিশেষ চিকিৎসার জন্য সরকারিভাবে দেশের একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয় পাবনা মানসিক হাসপাতাল। যেখানে বিশেষ চিকিৎসার পরিবর্তে মিলছে নতুন এক মানসিক ট্রমা। এ ট্রমার নাম মানসিক হেনস্তা। যেটি বর্তমানে দেদারসে করে যাচ্ছেন কথিত বিভিন্ন কনটেন্ট ক্রিয়েটররা। হাসপাতালে রোগীর স্বজন ছাড়া বাইরের কারোর প্রবেশাধিকার না থাকলেও নিরাপত্তারক্ষী আনসার সদস্যরা ৫০/১০০ টাকা নিয়ে অনায়াসে ভেতরে ঢুকছেন তারা। এরপর ভেতরে গিয়ে উত্ত্যক্তমূলক প্রশ্ন ও কর্মকাণ্ডে মানসিক রোগীদের হয়রানি করা হচ্ছে। কেউ দিচ্ছেন টাকা, আবার কেউ দিচ্ছেন সিগারেটও। এসব ভিডিও করে ছাড়া হচ্ছে ইউটিউব ও ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

সম্প্রতি হাসপাতালে ঢুকতে চাইলে গেটে থাকা দুই আনসার সদস্য ভেতরে গিয়ে আরেক আনসার সদস্য এনামুলের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। সেখানে ওই আনসার সদস্য জানান ভেতরে ঢুকতে গুণতে হবে টাকা। দরকষাকষির একপর্যায়ে ১০০ টাকায় রফাদফা হয়। এ টাকা দিলে ওই আনসার সদস্য নিজে ভেতরে পৌঁছে দেন। যার প্রমাণ রয়েছে জাগো নিউজের হাতে।

‘মানসিক বিপর্যয়ে’ পাবনা মানসিক হাসপাতাল

ভেতরে গিয়ে দেখা, যায় মানসিক রোগীদের বিনোদনের খোরাক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কেউ কেউ তৈরি করছেন ভিডিও। আর এসব ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এরকম কিছু ভিডিওতে দেখা যায়, রোগীদেরে বিড়ি দিচ্ছেন কেউ কেউ। নিজের গায়ে আঘাত করতে রোগীকে প্ররোচিত করাসহ অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে রোগীদের মানসিকভাবে হেনস্থাও করেন অনেকে।

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ হাসপাতালে রোগী আসে। কিন্তু বিভিন্নভাবে অনেকে হাসপাতালে ঢুকে তাদের নিয়ে তামাশা করে। ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে সেটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে। এগুলো রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্যে আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

এমন প্রশ্নের কিছুটা উত্তর মেলে সমাজকর্মী দেওয়ান মাহবুবের সঙ্গে আলাপকালে। তিনি বলেন, অন্যান্য রোগের মতো মানসিক রোগকেও স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখা উচিত। সঠিক চিকিৎসা পেলে মানসিক রোগীরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। এজন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ হাসপাতালে রোগী আসে। কিন্তু বিভিন্নভাবে অনেকে হাসপাতালে ঢুকে তাদের নিয়ে তামাশা করে। ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে সেটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে। এগুলো রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্যে আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

চিকিৎসক ও সমাজকর্মী ডা. রাম দুলাল ভৌমিক বলেন, মানসিক রোগীদের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপার রয়েছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের ফলে সেটি লঙ্ঘন হচ্ছে। এছাড়া রোগীদের নিরাপত্তাজনিত প্রশ্নটিও এখানে আসে। যে কেউ ভেতরে প্রবেশের ফলে যে কোনো সময় তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। এক্ষেত্রে এ ধরনের অপরাধমূলক কাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

এ ব্যাপারে হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা আনসারদের প্লাটুন কমান্ডার (পিসি) আখতারুজ্জামান বলেন, ভর্তি করতে আসা রোগীর সঙ্গে দু চারজন কখনো ভেতরে ঢুকে। কিন্তু আনসার সদস্যরা টাকা নিয়ে কখনো কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেন না। এক্ষেত্রে টাকা নেওয়ার প্রমাণ রয়েছে জানালেও তিনি সেটি মানতে নারাজ।

আরও পড়ুন
মানসিক রোগীদের ৯২ শতাংশই চিকিৎসার বাইরে, প্রধান অন্তরায় লজ্জা
দুর্যোগ পরিস্থিতিতে প্রতি পাঁচজনে একজন মানসিক রোগে আক্রান্ত হন
ব্যক্তিত্বজনিত মানসিক সমস্যা হতে পারে শৈশবের ট্রমা থেকে

শুধু এ সমস্যাই নয়। চিকিৎসকসহ জনবল, অবকাঠামো ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট নানা সংকটে দীর্ঘ সাড়ে ছয় দশকের মানসিক হাসপাতালের বেহাল দশা। ভবনের দেওয়াল ও ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ছে। লোহার রড বেরিয়ে গেছে কোথাও কোথাও। ভারী বৃষ্টি হলে ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে। প্রতিষ্ঠার পর কয়েক দফায় টুকটাক মেরামত হলেও আজও আধুনিক অবকাঠামোগত সুবিধা পায়নি হাসপাতালটি।

সম্প্রতি হাসপাতালে ঢুকতে চাইলে গেটে থাকা দুই আনসার সদস্য ভেতরে গিয়ে আরেক আনসার সদস্য এনামুলের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। সেখানে ওই আনসার সদস্য জানান ভেতরে ঢুকতে গুণতে হবে টাকা। দরকষাকষির একপর্যায়ে ১০০ টাকায় রফাদফা হয়। এ টাকা দিলে ওই আনসার সদস্য নিজে ভেতরে পৌঁছে দেন।

সবশেষ ২৫০ শয্যায় উন্নীত হবার পর হাসপাতালের জনবল কাঠামো নির্ধারণ করা হয়। ওই কাঠামো অনুযায়ী হাসপাতালে সিনিয়র কনসালটেন্ট এর দুটি পদ এখনো ফাঁকা। ঢাকার ২০০ শয্যার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ৫০ চিকিৎসক থাকলেও ৫০০ রোগীর পাবনা মানসিক হাসপাতালে পদ রয়েছে ৩১ চিকিৎসকের। আবার এর ৯টি পদ শূন্য রয়েছে। এছাড়া সবক্ষেত্রে রয়েছে জনবলের ঘাটতি। প্রথম শ্রেণির সাত কর্মকর্তার চারটি পদ শূন্য, নার্সসহ দ্বিতীয় শ্রেণির ৩১৬ কর্মকর্তার সাত পদ্য শূন্য, তৃতীয় শ্রেণির ১১৯ কর্মচারীর ২৩ শূন্য ও চতুর্থ শ্রেণির ১৭০ কর্মচারীর ১১০টি পদ শূন্য রয়েছে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা ও হাসপাতালের পরিবেশ।

যেসব মানসিক রোগী নিজেদের প্রাথমিক যত্ন নিতে অক্ষম, তাদের ভর্তি করা সম্ভব হয় না। ভালো কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি দেওয়া হয় না। নেই শিশুদের চিকিৎসার জন্য ইনডোর সুবিধা। আবার বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিজম সমস্যা নিয়ে আসা শিশুদের জন্য নেই অকুপেশনাল থেরাপি বা স্পিচ থেরাপির ভালো ব্যবস্থা।

‘মানসিক বিপর্যয়ে’ পাবনা মানসিক হাসপাতাল

মানসিক রোগীদের সুস্থ করে তুলতে নিবিড় পরিচর্যার পাশাপাশি প্রয়োজন খেলাধুলাসহ সুস্থ বিনোদন ব্যবস্থা। পূর্বে গানবাজনা ও সিনেমা দেখার ব্যবস্থা সহ বিনোদনের সুযোগ থাকলেও এখন সেটি নেই। সিনেমা হলটি দীর্ঘদিন বন্ধ। এছাড়া মানসিক রোগীদের জন্য যেমন সৌন্দর্যবর্ধিত পরিবেশ থাকা প্রয়োজন, ভেতরে বা বাহিরে কোথাও নেই তেমনটি। উল্টো হাসপাতাল কম্পাউন্ড ঝোপঝাড়ে ভরা। বৃষ্টি হলে জমে পানি। এতে মশার উৎপাত বেড়ে যায়।

চিকিৎসকসহ জনবল, অবকাঠামো ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট নানা সংকটে দীর্ঘ সাড়ে ছয় দশকের মানসিক হাসপাতালের বেহাল দশা। ভবনের দেওয়াল ও ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ছে। লোহার রড বেরিয়ে গেছে কোথাও কোথাও। ভারী বৃষ্টি হলে ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে।

এছাড়া ভর্তি রোগীর জন্য সকাল, সন্ধ্যার নাস্তা ও দুবেলার খাবারের জন্য প্রতিদিন ১৭৫ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এ থেকে ভ্যাট ও ট্যাক্স বাদ দিয়ে যা টেকে তা মানসিক রোগীর পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারের জন্য অপ্রতুল। ভর্তি রোগীর বাইরেও হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ২০০-৩০০ রোগী চিকিৎসা নিয়ে থাকেন।

অভিযোগ রয়েছে, চিকিৎসক সংকটের কারণে সকাল থেকে দুপুর ১২টার পর আর রোগী দেখা হয় না। হাসপাতাল এলাকায় নেই আবাসন ব্যবস্থা। আবার মানসিক রোগীদের জন্য আবাসিক হোটেল ভাড়া মেলে না। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীর স্বজনরা পড়েন ভোগান্তিতে। এ ছাড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও জনবল না থাকায় হাসপাতালের বাইরে থেকে চড়া মূল্যে পরীক্ষা করাতে হয় রোগীদের। অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই দেওয়া হয় চিকিৎসাপত্র। কিন্তু বরাদ্দ সংকটে সে চিকিৎসাপত্র অনুযায়ী বিনামূল্যে সরকারি ওষুধ দুয়েকটি মিললেও বাকিগুলো বাইরে থেকে কিনতে হয় রোগীদের।

কুষ্টিয়ার শমেসপুর থেকে স্বামীকে নিয়ে আসা সালমা খাতুন বলেন, গত ৬-৭ মাস হয় ঠিকমতো ওষুধ মেলে না। দুটো দিলে তিনটা নাই। বাইরে থেকে কিনতে হয়। গরিব বলে এতদূর থেকে সরকারি হাসপাতালে আসি। কিন্তু সে উপকারটুকুও হয় না।

রংপুর থেকে মানসিক রোগী ভাইকে নিয়ে আসা মইনুল বলেন, আসার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন দালাল আমাকে ঘিরে ধরে। ১৬ হাজার ৮০০ টাকা দিলে রোগী ভর্তির সব ব্যবস্থা তারা করে দেবে বলে জানায়। তাদের ফাঁদে পা না দেওয়ায় তারা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করেছে।

পাবনা জজ কোর্টের এপিপি ও মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য আইনে কিছু বিষয় স্পষ্ট নয়। ফলে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে যে ধরনের পদক্ষেপ নেবার সুযোগ রয়েছে সেক্ষেত্রেও অনেক সময় জটিলতার সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে আইনটিতে সংশোধনী এনে যুগোপযোগী করা উচিত।

পাবনা মানসিক হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. নাঈম আকতার আব্বাসী বলেন, এ ধরনের রোগীদের উত্ত্যক্ত করা, অবহেলা বা মানসিক হেনস্তার বিষয়টি মানসিক স্বাস্থ্যসেবার পরিপন্থি। এর ফলে তাদের যে রিকভারি ফেস সেটি প্রলম্বিত হয়। এক্ষেত্রে সবার সচেতনতা ও যত্ন বাড়াতে হবে।

‘মানসিক বিপর্যয়ে’ পাবনা মানসিক হাসপাতাল

হাসপাতালের চিকিৎসা তত্ত্বাবধায়ক ডা. এহিয়া কামাল জাগো নিউজকে বলেন, জনবল ও অন্যান্য সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে আমাদের। ২৫০ শয্যার জনবল কাঠামোয় ৫০০ শয্যার হাসপাতাল পরিচালিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে জনবল ঘাটতি পূরণ ও শতভাগ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতে শূন্যপদে নিয়োগ, পদ সৃজন, অবকাঠামোসহ উন্নত চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রয়োজন। এত সংকট থাকলেও আমাদের পক্ষ থেকে রোগীদের প্রতি কোনোধরনের অবহেলা করা হয় না।

তিনি বলেন, এ হাসপাতালকে আন্তর্জাতিক মানের ইনস্টিটিউট হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এটি এখন একনেকের পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে।

পাবনার সিভিল সার্জন আবুল কালাম আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সবারই আরও আন্তরিক হওয়া উচিত। জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

আলমগীর হোসাইন নাবিল/আরএইচ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।