২০ বছরেও হদিস মেলেনি কল্পনা চাকমার


প্রকাশিত: ০৪:৩৯ এএম, ০১ জুন ২০১৬

শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, দেশে-বিদেশে বহুল আলোচিত ঘটনা কল্পনা চাকমা অপহরণ। কিন্তু দীর্ঘ ২০ বছরেও হদিস মেলেনি কল্পনা চাকমার। উদঘাটন হয়নি ঘটনার কোনো রহস্য। এর কোনো সুস্পষ্ট জবাব নেই সরকারের।

এতটা বছর ধরে কল্পনা চাকমা কোথায় রাষ্ট্রের কাছে জবাব চেয়ে আসছেন তার পরিবারসহ গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ। কিন্তু সরকার থেকে কোনো সঠিক জবাব মেলেনি।

১৯৯৬ সালের ১২ জুন রাতে রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে অপহরণের শিকার হন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমা।

ঘটনাটির জন্য সেই সময়ের স্থানীয় সেনাক্যাম্প কমান্ডার লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস ও তার সহযোগীদের প্রকাশ্যে দায়ী করে কল্পনার পরিবার। ফেরদৌসসহ অন্যদের আসামি করে মামলাও করেছে তারা। কিন্তু সুষ্ঠু তদন্ত-বিচার আজও কিছুই নেই।

কল্পনার দুই বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা (কালীচরণ) ও লাল বিহারী চাকমা (ক্ষদিরাম) বলেন, কল্পনাকে অপহরণকালে তাদের দুই ভাইকে বাড়ির বাইরে নিয়ে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করে অপহরণকারীরা। কিন্তু পালিয়ে প্রাণে বেঁচে গেছেন তারা।

ঘটনার পর কল্পনার বড়ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা বাঘাইছড়ির তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে দেয়া জবানবন্দিতে অপহরণকারীদের মধ্যে স্পষ্টতই টর্চের আলোতে তাদের বাড়ির পাশে কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস এবং তার পাশে দাঁড়ানো ভিডিপি প্লাটুন কমান্ডার নুরুল হক ও ছালেহ আহমেদকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হন বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

পরে কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলা সম্পর্কে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দেয় বাঘাইছড়ি থানা পুলিশ। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করেন মামলার বাদী ও তার পরিবারসহ বিভিন্ন মহল। পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি, হিল উইমেন্স ফেডারেশন বিভিন্ন মহলের পক্ষে আরও শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করে অবিলম্বে আসামিদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবিও জানিয়েছেন।

কল্পনা চাকমার পরিবারের অভিযোগ, নিজ বাড়ি থেকে ঘুমন্ত কল্পনা চাকমাকে উঠিয়ে মা ও দুই ভাইয়ের সামনে থেকেই তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস। কিন্তু সেই থেকে কল্পনা চাকমার আর কোনো হদিস নেই।

অনেকের ধারণা, কল্পনাকে অপহরণের পরপরই শারীরিক নির্যাতন করে হত্যার পর তার লাশ গুম করা হয়েছিল। কিন্তু তার সঠিক কোনো তথ্য-প্রমাণও মেলেনি।

ঘটনার পর এর প্রতিবাদে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশ-বিদেশে ব্যাপক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের ঝড় ওঠে। এতে ব্যাপক জনমত ও আন্দোলনের চাপে সরকার ১৯৯৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি আব্দুল জলিলকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু ওই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আজও প্রকাশ করা হয়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১০ সালের ২১ মে বাঘাইছড়ি থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহম্মদ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। ওই প্রতিবেদনে কল্পনা চাকমার সন্ধান পাওয়া যায়নি মর্মে উল্লেখসহ মামলাটি বাতিলের আবদেন জানানো হয়।

কিন্তু মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা নারাজি আবেদন জানান। এতে বিচারক সিআইডির মাধ্যমে পুর্নতদন্তের নির্দেশ দেন। ওই নির্দেশে সিআইডি কর্মকর্তা মো. শহীদুল্লাহ ২০১২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দেন। কিন্তু ওই তদন্ত প্রতিবেদনেও প্রকৃত দোষীদের নাম উল্লেখ করা হয়নি বলে অভিযোগ করেন বাদীপক্ষ।

এরপর ২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি সিআইডি প্রতিবেদনের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে রাঙামাটির অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম মো. সিরাজুদ্দৌল্লাহ কুতুবী রাঙামাটি পুলিশ সুপারকে (এসপি) মামলার পুর্নতদন্তের আদেশ দেন। ওই আদেশে তদন্ত শেষে ২০১৪ সালের ২০ জুলাই রাঙামাটির চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

তদন্ত প্রতিবেদনে তৎকালীন পুলিশ সুপার আমেনা বেগম বলেছেন, মামলার তদন্তভার নেয়ার পর তিনি ঘটনাস্থল পুনঃপরিদর্শন করেছেন। তদন্তকালে কয়েক সাক্ষীর সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। তারা আগের তদন্তদকারী কর্মকর্তাদের কাছে যে বক্তব্য দিয়েছেন জিজ্ঞাসাবাদে আমার কাছেও একই জবানবন্দি দেন।

তিনি আরও বলেন, মামলার ঘটনাস্থল সঠিক পাওয়া গেছে। বিজ্ঞ আদালতের আদেশ মতে লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস এবং ভিডিপি সদস্য নুরুল হক ও ছালেহ আহমেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের লিখিত জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। তাদের জবানবন্দিতে পাওয়া তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মামলার ঘটনাটি প্রায় দেড়যুগ আগের। ঘটনার সময় ভিকটিম ছিলেন কলেজছাত্রী। ১৮ বছর পর ভিকটিমের চেহারায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখনও ভিকটিমকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ভবিষ্যতে ভিকটিম উদ্ধার হলে চেহারা দেখে তাকে সনাক্ত নাও করা যেতে পারে।

তাই তার বড় ভাইয়ের ডিএনএ সংগ্রহ করার জন্য আদালতের আদেশ পাওয়া গেলেও মামলার বাদী এবং তার বড়ভাই লাল বিহারী চাকমা ডিএনএ সংরক্ষণে আগ্রহী নন। সেজন্য এখনও তাদের ডিএনএ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

মামলার মূল সাক্ষী কল্পনা চাকমা নিজেই। তাই কল্পনা উদ্ধার না হওয়া বা তার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না পাওয়া পর্যন্ত মামলার তদন্ত শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। মামলার ভিকটিম কল্পনা চাকমাকে উদ্ধারের ব্যাপারে জোর প্রচেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে।  

এসএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।