ঐতিহ্য থেকে বিশ্ববাজারে বগুড়ার লাচ্ছা সেমাই

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক বগুড়া
প্রকাশিত: ০৪:৩৬ পিএম, ২৫ মার্চ ২০২৫
বগুড়ার লাচ্ছা সেমাই স্বাদ, গুণগত মান ও খ্যাতির দিক থেকে অন্যসব এলাকার চেয়ে আলাদা/ছবি-জাগো নিউজ

ঈদুল ফিতর মানেই উৎসব, আনন্দ আর বাহারি খাবারের সমারোহ। সেই খাবারের অন্যতম আকর্ষণ লাচ্ছা সেমাই। বিশেষ করে বগুড়ার লাচ্ছা সেমাই স্বাদ, গুণগত মান ও খ্যাতির দিক থেকে অন্যসব এলাকার চেয়ে আলাদা। এবার সেই সেমাই দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বাজারেও জায়গা করে নিচ্ছে। চলতি মৌসুমে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার লাচ্ছা সেমাই উৎপাদিত হচ্ছে, যার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ যাচ্ছে দেশের বাইরে।

শত বছরের ঐতিহ্য বহন করছে বগুড়ার লাচ্ছা সেমাই। এখানকার কারিগররা বিশেষ কৌশলে সুস্বাদু ও মচমচে লাচ্ছা তৈরি করেন। প্রতিটি কারখানায় দৈনিক শতাধিক টন সেমাই উৎপাদন হচ্ছে। এ খাতে প্রায় ছয় হাজার শ্রমিক নিয়োজিত।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের বাজার ছাড়িয়ে বগুড়ার লাচ্ছা সেমাই রপ্তানির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে যাচ্ছে। এরইমধ্যে সৌদি আরব, কাতার ও ইয়েমেনে সেমাই পাঠানো শুরু হয়েছে। বিদেশে বগুড়ার লাচ্চা সেমাইয়ের বাজার তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আকবরিয়া গ্রুপসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, সরকার যদি রপ্তানি নীতিমালায় শিথিলতা আনে, তাহলে বগুড়ার লাচ্ছা সেমাই আন্তর্জাতিক বাজারেও বিশাল অবস্থান তৈরি করতে পারবে। এরইমধ্যে সীমিত পরিমাণে পাঠানো লাচ্চার বাজার অনেক ভালো হওয়ায় ব্যবসায়ীরা এ ব্যাপারে আগ্রহী হচ্ছেন।

আরও পড়ুন:

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বগুড়ার প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম আকবরিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসান আলী আলাল জানান, তার বাপ-দাদার পূর্বপুরুষেরা কলকাতার বাসিন্দা ছিলেন। শত বছর আগে বগুড়ায় আসেন তারা। ওই সময় থেকেই অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি সেমাই তৈরি শুরু করেন। সময়ের ব্যবধানে সেমাই উৎপাদনে বগুড়ার বিখ্যাত দইয়ের মতো ব্র্যান্ড তৈরি করেছেন তারা।

ঐতিহ্য থেকে বিশ্ববাজারে বগুড়ার লাচ্ছা সেমাই

হাসান আলী বলেন, বগুড়ায় রোজার দেড় মাসে উৎপাদিত বেশিরভাগ সেমাই তাদের। বলতে গেলে এক তৃতীয়াংশ উৎপাদন করেন তারা। এই সেমাইয়ের চাহিদা আর সুনাম রয়েছে দেশব্যাপী। তবে সৌদি আরব, কাতার, ইয়েমেনে আকবরিয়ার লাচ্ছা সেমাই যাচ্ছে কয়েক বছর ধরে। বাণিজ্যিকভাবে ওসব দেশে বাজার তৈরির চেষ্টা চলছে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

যেভাবে তৈরি হয় বিখ্যাত লাচ্ছা

লাচ্ছা সেমাই তৈরি হয় বিশেষ কৌশলে ময়দা, পানি ও ডালডার মিশ্রণে। এরপর চাকা বানিয়ে পাতলা স্তরে সাজিয়ে কয়েক ধাপে ভাজা হয়। একাধিক ধাপে ভাজার ফলে এটি একদম মচমচে ও সুস্বাদু হয়। এই জটিল প্রক্রিয়ায় দক্ষ শ্রমিকদের প্রয়োজন হয়, যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই কাজে অভ্যস্ত।

এই বছর কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির ফলে লাচ্ছা সেমাইয়ের মূল্যও বেড়েছে। বর্তমানে সয়াবিনে ভাজা লাচ্ছা ২৪০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি, ডালডায় ভাজা লাচ্ছা ২২০-২৮০ টাকা এবং ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা ৮০০-১৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানান, আগের চাইতে কাঁচামালের দাম বেড়েছে। ফলে সেমাই উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে। ফলে বাজারে দাম বেড়েছে। তবে চাহিদা থাকায় বিক্রিও হচ্ছে প্রচুর।

আরও পড়ুন:

বিজ্ঞাপন

শ্রমিকদের কর্মসংস্থান ও আয়

প্রতি ঈদ মৌসুমে শত শত শ্রমিক লাচ্ছা সেমাই তৈরির কাজে যুক্ত হন। প্রতিটি কারখানায় ৮-১২ জনের একাধিক দল গঠন করে কাজ করা হয়। কারিগরদের মতে, প্রতিদিন একেকটি দল সর্বনিম্ন ১২ বস্তা আটা-ময়দার সেমাই প্রস্তুত করতে পারে। অনেকেই মৌসুমি কাজ হিসেবে এই পেশায় যুক্ত হন। এতে মাসে ৩০-৪৫ হাজার টাকা আয় করতে পারেন তারা। তবে সমস্যাও রয়েছে অনেক। কারণ লাচ্ছা সেমাই শিল্পে বর্তমানে কাঁচামালের দামের ওঠানামা, দক্ষ শ্রমিক সংকট এবং আধুনিক প্রযুক্তির অভাবের কারণে কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। উদ্যোক্তারা মনে করেন, সরকার যদি বিশেষ প্রণোদনা দেয় এবং প্রশিক্ষিত কারিগর তৈরি করা হয়, তাহলে এই শিল্প আরও প্রসারিত হবে।

ঐতিহ্য থেকে বিশ্ববাজারে বগুড়ার লাচ্ছা সেমাই

বগুড়ার সাবগ্রাম ইউনিয়নের বাসিন্দা আকবর আলী পেশায় একজন দক্ষ সেমাই কারিগর। দুই যুগ ধরে তিনি এ পেশায় যুক্ত। শুরুতে শহরের চেলোপাড়ায় কাজ করলেও এখন একটি কনফেকশনারিতে কাজ করছেন।

বিজ্ঞাপন

আকবর আলী জানান, স্বাধীনতার আগে বগুড়ায় সেমাই তৈরির শিল্পে বিহারিদের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। তখনকার স্থানীয় কারিগররা মূলত শহরের কলোনি এলাকায় বসবাসরত বিহারিদের কাছ থেকেই এই দক্ষতা অর্জন করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিটি কারখানায় ৮ থেকে ১২ জনের একটি দল একসঙ্গে কাজ করে। কেউ খামির তৈরি করেন, কেউ সেমাইয়ের চাকা বানান, কেউ তেলে ভাজেন। বাকিরা সেমাই খাচিতে তোলেন বা প্যাকেটিংয়ের কাজ করেন। প্রতিটি দল প্রতিদিন ১২ বস্তা আটা-ময়দার সেমাই প্রস্তুত করতে সক্ষম। তবে সারা বছর এই কাজ থাকে না। অনেক কারিগর শুধু রোজার সময়েই সেমাই তৈরির কাজে যুক্ত হন।

আরও পড়ুন:

বিজ্ঞাপন

শহরের গোয়ালগাড়ী এলাকার কারিগর আনোয়ার হোসেন বলেন, উত্তরবঙ্গে বগুড়ার মতো মানসম্মত লাচ্ছা সেমাই আর কোথাও তৈরি হয় না। এখানকার কারিগররা অভিজ্ঞ। তাই সেমাইয়ের স্বাদ ও গুণগত মানও চমৎকার হয়। এ কারণেই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বগুড়ার সেমাইয়ের ব্যাপক চাহিদা থাকে। রমজান মাসে আমরা প্রচুর কাজ পাই। ফলে এক মাসে ৩০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব হয়।

সেমাই শিল্পের সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল করার জন্য নতুন উদ্যোক্তারাও যুক্ত হচ্ছেন। এমনই একজন হলেন ডা. রোকনুজ্জামান সোহাগ। পেশায় চিকিৎসক হলেও বিগত তিন বছর ধরে তিনি সেমাই উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। রোজার মৌসুমকে কেন্দ্র করে নিজের বাসায় একটি ক্ষুদ্র কারখানা গড়ে তুলেছেন, যেখানে ১০ থেকে ১৫ জন শ্রমিক কাজ করেন।

ঐতিহ্য থেকে বিশ্ববাজারে বগুড়ার লাচ্ছা সেমাই

বিজ্ঞাপন

ডা. রোকনুজ্জামান সোহাগ বলেন, ‘বগুড়ায় তৈরি সেমাইয়ের মূল বাজার আসলে ঢাকা ও চট্টগ্রামে। রমজান মাসে প্রতিদিন সেমাইয়ের অর্ডার পাই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে। শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও বগুড়ার লাচ্ছা সেমাই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। সম্প্রতি আমার এক বন্ধু অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট করার জন্য সেমাই নিয়েছিল। সেখানকার পাকিস্তানি সেমাইয়ের তুলনায় বগুড়ার লাচ্ছা অনেক বেশি সুস্বাদু বলে সে জানিয়েছে। এখন সে কয়েকশ কেজি সেমাই কিনতে চায়।

তবে ব্যবসায়ীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি। হু হু করে দাম বাড়ায় সেমাইয়ের উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে। ফলে এবারের ঈদে বাজারে সেমাইয়ের দামও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।’

আরও পড়ুন:

জেলা বিসিক কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজুর রহমান জানান, বগুড়ায় তৈরি সেমাইয়ের মান উন্নত হওয়ায় ড্যানিশ, বনফুলসহ বেশ কিছু ব্র্যান্ড বিসিক এলাকায় কারখানা স্থাপন করেছে। তারা স্থানীয় দক্ষ কারিগরদের ব্যবহার করে মানসম্মত লাচ্ছা উৎপাদন করছেন। ভবিষ্যতে এই খাতে আরও বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

সামাজিক সংগঠন সুপ্রর জেলা সম্পাদক কেজিএম ফারুক বলেন, বগুড়ার লাচ্ছা সেমাই শুধু একটি খাবার নয়, এটি একটি ঐতিহ্য এবং সম্ভাবনাময় শিল্প। যদি এই শিল্পকে আরও আধুনিকায়ন করা যায় এবং রপ্তানির সুযোগ বাড়ানো হয়, তাহলে এটি দেশের অন্যতম লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হতে পারে। সরকার, উদ্যোক্তা এবং শ্রমিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বগুড়ার লাচ্ছা সেমাই বিশ্ববাজারে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।

এসআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।