কক্সবাজারে মৃত ব্যক্তিসহ ৭২০ জনের নামে মামলা

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) যাত্রার পর দলটির আহ্বায়ক ও জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের অন্যতম প্রধান নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘বৈষম্যবিরোধী বা সমন্বয়ক’ পরিচয়ের এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। ৭ মার্চ এ ঘোষণা এলেও কক্সবাজারে এখনো ‘বৈষম্যবিরোধী বা সমন্বয়ক’ পরিচয়ে অনেকে বিচরণ করে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র প্রতিনিধি পরিচয়ে গত ২১ মার্চ কক্সবাজারে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী, ব্যবসায়ীসহ ৭২০ জনের নামে কক্সবাজার সদর থানায় মামলা করেছেন এনামুল হক নামে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর এক যুবক। মামলায় ৫২০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত হিসেবে ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে বিস্ময় প্রকাশ পেয়েছে মামলায় আওয়ামী লীগের দু’জন মৃত নেতার নাম ও জমি সংক্রান্ত বিষয়ে মামলা চলা বাদী-বিবাদী পক্ষের অনেকে এ মামলায় আসামি হওয়ায়। একেক জনের নাম তিনবারও উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকা ব্যক্তি, রাজনীতির সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকা লোকজনও আসামির তালিকায় রয়েছেন।
৭২০ জনের বিরুদ্ধে করা মামলার বিষয়টি শনিবার রাতে প্রকাশ পাওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। অনেকেই এই মামলাকে ‘নাটকীয়’ ও ‘বিতর্কিত’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। নেটিজেনদের মধ্যে বিষয়টি হাস্যরসের খোরাক হয়ে উঠেছে, যা নিয়ে অনেকে ব্যঙ্গাত্মক স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। ফলে জেলাজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে চাঞ্চল্যের।
শুক্রবার (২১ মার্চ) রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি দাবি করা মামলার বাদী এনামুল হক চট্টগ্রামের বাঁশখালীর চাম্বল ইউনিয়নের ছাদেক ফকির পাড়ার নবী হোসেনের ছেলে। বর্তমানে তিনি কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা ইউনিয়নে থাকেন এবং শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
মৃত ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, নিরীহ ব্যক্তিদের নাম আসায় সমালোচনা হচ্ছে দেখে, মামলার বাদী এনাম অনেককে বলছেন, ‘আওয়ামী লীগ করলেও যারা জনগণের ক্ষতি করেননি বলে প্রমাণ দিবেন, তাদের জন্য বিচারকের কাছে গিয়ে নাম কাটার আবেদন করবেন।’ এসব জানার পর অনেকে মামলাটি ধান্ধাবাজির জন্য করা হয়েছে বলে মন্তব্য করছেন। অনেকে আবার মামলা গ্রহণকারী ওসির ‘দায়িত্বজ্ঞান’ নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন।
এদিকে জেলার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক সাবেক সমন্বয়কসহ সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, তারা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। মামলাটির ব্যাপারে আগে কোনো ধারণাই পাননি তারা।
জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া আওয়ামী লীগ নেতা জাফর আলম মাঝিকে মামলার আসামি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জামিল হোসাইন, যিনি চলতি বছরের ১৬ মার্চ মারা গেছেন, তাকেও ৩৯৪ নম্বর আসামি করা হয়েছে। মৃত ব্যক্তিদের নাম আসামি তালিকায় থাকায় এ মামলার নির্ভুলতা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়েছে।
এছাড়াও ৩০০, ৩০৭ ও ৩১৫ নম্বরে ফারুক নামে টেকনাফের এক যুবককে তিনবার আসামি করা হয়েছে। তাকে এক জায়গায় সাবেক এমপি বদির বোন জামাই, অন্যটিতে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও টেকনাফ ডিগ্রি কলেজের সহ-সভাপতি উল্লেখ করা হয়েছে। ১৭২, ৪৬৩ নম্বরে দুইবার ঈদগাঁও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইমরুল হাসান রাশেদকে আসামি করা হয়েছে।
তিনবার তিন ধরনের পরিচয়ে ব্যবসায়ী ওবাইদুল হোছাইনকে ৭৭, ২৮৩ ও ৩৭৭ নম্বরে আসামি করা হয়েছে। এছাড়াও ৪২৭ নম্বরে আসামি করা হয়েছে আড়াই বছর ধরে দুবাইতে থাকা প্রবাসী ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আয়ুব আলীকে। আরও চারজনকে দুইবার করে আসামি করা হয়েছে। যা হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের অনিয়মের মামলায় আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ কমতে পারে এবং নিরাপরাধ ব্যক্তির হয়রানির আশঙ্কা তৈরি হয়।
আওয়ামী লীগ নেতা মৃত জাফর আলমের ছেলে সাইফুল ইসলাম বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার বাবা জাফর আলম ঈদগাঁওয়ের ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ক্যানসারে ভুগছিলেন এবং ২০২৩ সালের ৬ জুন তার অপারেশন হয়। এরপর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বিকেলে তিনি মারা যান। অথচ তার নাম মামলার আসামির তালিকায় দেখে আমরা হতবাক। বাবা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে আওয়ামী লীগ করেছিলেন বলে কবরেও থাকতে পারবেন না?
অভিযোগ আছে, মামলার এজাহারের কপি ১৫-২০ দিন আগেই অনেক আসামির কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। সাধারণত মামলা দায়েরের পর আসামির নাম ঠিকানা প্রকাশ হয়, কিন্তু এতদিন আগেই মামলার কপি পৌঁছানোর ঘটনাকে পরিকল্পিত ‘ধান্ধাবাজি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন অনেকে। তাদের মতে, মামলার আগেই কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা চাওয়া হয়। টাকার বিনিময়ে কিছু ব্যক্তির নাম বাদ দেওয়া ও টাকা পেয়ে নাম যোগ করা হয়। এতে করে মামলার স্বচ্ছতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক জিনিয়া শারমিন রিয়া তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘কক্সবাজার জেলার ব্যানারে কক্সবাজার সদর থানায় ইতিমধ্যে ৫২০ জনকে আসামি করে যে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে- আমি জিনিয়া এই মামলা সম্পর্কে মোটেও অবগত নই সুতরাং মামলার এজাহারে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির নাম এসেছে বা কোন মৃত ব্যক্তির নাম এসেছে সে ব্যাপারে বিরক্ত না করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।’
৫২০ জনের মামলা নিয়ে সাবেক ছাত্র প্রতিনিধি সাহেদ লিখেছেন, ‘আল্লাহর নামে কসম করে বলতেছি আমি এই মামলা সম্পর্কে অবগত না।’
আরেক প্রতিনিধি রিয়াদ মনি লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনাও এইভাবে মৃত মানুষকে মামলা দিত। কলঙ্কের দাগ লাগতেছে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে- কারা মামলাবাজ, চাঁদাবাজ ও টেন্ডারবাজ জাতির কাছে ক্লিয়ার হয়ে যাচ্ছে।’
কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৌদি প্রবাসী ইমরুল হাসান রাশেদ বলেন, মামলার বাদী এনাম শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ঘটনার ৮ মাস পর করা মামলাটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। শিবিরের কর্মশালাসহ নানা প্রোগ্রামে তার ছবি এরইমধ্যে ভাইরাল হয়েছে।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ইলিয়াস খান বলেন, মামলা হয়েছে- তদন্ত হবে, এতে মৃত বা নিরীহ ব্যক্তির নাম পাওয়া গেলে বাদ যাবে।
গত ৭ মার্চ এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ‘বৈষম্যবিরোধী বা সমন্বয়ক’ পরিচয়ের এখন কোনো অস্তিত্ব নেই বলে ঘোষণা দেওয়ার পক্ষকাল পরও কেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র প্রতিনিধি পরিচয়ে বহিরাগত যুবকের এজাহার মামলা হিসেবে গ্রহণ করলেন, এমন প্রশ্নে ওসি বলেন- ‘বাদীকে এখানকার সমন্বয়কদের সঙ্গে আমি আসার পর থেকেই দেখেছি। তার এজাহারটি ধর্তব্য অপরাধ বলে গণ্য হওয়ায় মামলা হিসেবে নিয়েছি।
মামলার ভুল ফেসবুক ও গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নে উঠে আসছে-এতে তদন্ত কাজ সহজ হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সায়ীদ আলমগীর/এফএ/জিকেএস