ইফতারে বেড়েছে কদর, বগুড়ায় দই বিক্রির ধুম

রমজানে ইফতার মানেই ভাজাপোড়া, শরবত, খেজুর আর নানা সুস্বাদু খাবারের সমাহার। কিন্তু গরমের দিনে সারাদিন রোজা রাখার পর এমন কিছু চাই, যা একদিকে শরীরকে ঠান্ডা করবে, অন্যদিকে হজমে সহায়ক হবে। এই তালিকায় বছরের পর বছর ধরে এক বিশেষ জায়গা দখল করে রেখেছে বগুড়ার বিখ্যাত টকদই।
এটি শুধু স্বাদে নয়, গুণেও অতুলনীয়; রোজাদারদের শরীরে প্রশান্তি আনে, হজমশক্তি বাড়ায় এবং ইফতারের পর উপহার দেয় এক অনন্য স্বাদ। এক বাটি ঠান্ডা দই পানির তৃষ্ণা মেটায়। পরবর্তী খাবারের জন্য প্রস্তুত করে পাকস্থলীকে।
শতবর্ষের ঐতিহ্য আর খাঁটি দুধের মিশেলে তৈরি এই দই এখন শুধু বগুড়াতেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং ঢাকাসহ দেশের নানা ইফতার বাজারেও দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দোকান ছাড়াও অনলাইনে মিলছে এই দই।
আর বগুড়ার দইয়ের খ্যাতি শত বছরের পুরোনো। সম্প্রতি বগুড়া রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বগুড়ার সরার দইকে জিআই পণ্য হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। ফলে বগুড়ার দই বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে বিশ্বে এটির মর্যাদা যেমন বেড়েছে, তেমনি রপ্তানিতেও সুবিধা মিলবে।
দই ব্যবসায়ীরা জানান, গরুর খাঁটি দুধের সর থেকে দই তৈরি হয়, কোনো কৃত্রিম সংযোজন ব্যবহার করা হয় না। দইয়ের ঘনত্ব বজায় রাখতে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রেখে জমিয়ে তারপর বাজারজাত করা হয়। এই নিখুঁত প্রক্রিয়ার জন্যই বগুড়ার দই দেশের অন্যান্য অঞ্চলের দইয়ের তুলনায় সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর বলে বিবেচিত।
আরও পড়ুন:
একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বগুড়ায় রমজান এলেই বেড়ে যায় টক দইয়ের চাহিদা। যে কারণে বিভিন্ন শোরুম ছাড়াও মুদিদোকান, রাস্তায়, ফেরি করে, পাড়া-মহল্লায় অস্থায়ী টেবিলে করে বিক্রি হয় এটি। দোকানে ৭০-২৮০ টাকায় টক ও ভিন্ন স্বাদের দই বিক্রি হয়। আর ফুটপাতে আকারভেদে ৬০-১৮০ টাকায় একই ধরনের দই মেলে। তবে ফুটপাতের দই ঘনত্বের দিক থেকে কিছুটা পাতলা হলেও রোজাদার ব্যক্তিদের জন্য ইফতারে সেটির আকর্ষণ আছে। এখন চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় টক দইয়ের সরবরাহ দিতে পারছেন না দই ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা জানান, রমজানে জেলায় প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকার টক ও সাদা দই বিক্রি হচ্ছে। এই হিসেবে মাসে প্রায় ৮-১০ কোটির টাকার দই বিক্রি হবে। যা অন্যান্য সময়ের তুলনায় প্রায় তিন থেকে চারগুণ বেশি। তবে এই হিসেবের বাইরে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা রয়েছেন। এদের হিসেব যোগ করলে বিক্রির টাকার অংকটা আরও বেড়ে যাবে।
শহরের হিরোন নামের একজন ব্যবসায়ী জানান, দই তৈরির সময় যতটা প্রয়োজন, তা পাওয়া যাচ্ছে না। চাহিদা প্রচুর রয়েছে। তিনি বাড়িতে স্বল্প পরিসরে দুইশ পাত্রের কিছু বেশি সাদা দই তৈরি করে নবাববাড়ি সড়কে ফুটপাটে বসেছিলেন। মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে সব দই শেষ হয়ে যায়।
তিনি বলেন, রমজানে দইয়ের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। চাহিদামতো সরবরাহ করা যায় না। উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন দইয়ের দামও বেড়েছে। ফুটপাতে লম্বা ডুঙ্গিতে (পাত্র) টক ও সাদা দই মিলছে ৭০-২০০ টাকার মধ্যে। ঈদের আগে এই চাহিদার সঙ্গে দামও কিছুটা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বগুড়া আকবরিয়া লিমিটেডের চেয়ারম্যান হাসেন আলী আলাল জানান, তার প্রতিষ্ঠানে তৈরি দই আমেরিকায় গেছে বেশ কয়েকবার। তবে এটি বাণিজ্যিকভাবে নয়। প্রবাসীরা বগুড়ায় এলে তাদের স্বজনদের জন্য দই নিয়ে যান। তিনি মনে করেন, এই খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে সরকারি প্রণোদনার দরকার। প্রয়োজন ভ্যাট-ট্যাক্স ছাড় ও সংরক্ষণ ব্যবস্থায় সহায়তা।
আরও পড়ুন:
টক দই কিনতে আসা আবুল কাদের বলেন, সারাদিন পর রোজার ক্লান্তি দূর করতে সাদা দইয়ের ঘোল খুব উপকারী। পরিবারেরও সবার পছন্দের।
চিনিপাতা দইয়ের মালিক মুক্তার আলম জানান, মূলত দুধ আর চিনির মানের ওপর নির্ভর করে এ খাবার। বগুড়ায় প্রতিদিন গড়ে অন্তত ৩০ টন দই তৈরি হয়, যা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। তবে ছুটির দিনগুলোতে আরও অন্তত ১০ টন দইয়ের চাহিদা বেড়ে যায়। উৎসবের দিনগুলোতে এ চাহিদা আরও বৃদ্ধি পায়। এখন মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ার কারণে মিষ্টি দইকে এড়িয়ে চলেন। তাদের চাহিদায় প্রথমেই থাকে টক অথবা সাদা দই। অন্য সময়ের চেয়ে রোজার মাসে এই দই নিতে রীতিমতো লম্বা লাইন দিতে হয় ক্রেতাদের।
বগুড়া শহরের খান্দার এলাকায় ভাঁড়ে করে দই বিক্রি করেন জামাল হোসেন। তিনি রমজানে প্রতিদিন ১৫ হাজার টাকার মতো টক দই বিক্রি করেন। নিজের ভ্যান ছাড়াও অটোভ্যানে করে দই নিয়ে আসেন। মাত্র ২ থেকে ৩ ঘণ্টা সময়েই সব দই বিক্রি করে বাড়ি ফিরে যান। জামাল বলেন, এবার দইয়ের দাম ১০-২০ টাকা করে বেড়েছে। তারপরও ক্রেতার চাহিদা কমেনি।
বগুড়া শহরেই রয়েছে ১০০টি দইয়ের দোকান। এছাড়া শহরের আশপাশে রয়েছে আরও ২০০টির মতো দোকান। এসব দোকানে প্রতিদিন প্রচুর দই বিক্রি হচ্ছে। দই মানেই খাঁটি দুধের স্বাদ, ঘন মিশ্রণ এবং প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি এক অনন্য পণ্য। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ক্রেতারা অভিযোগ করছেন, এই দইয়ের স্বাদ, গুণগত মান এবং ঘনত্ব আগের মতো থাকছে না। বিশেষ করে রমজানে চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করে লাভের আশায় দইয়ের গুণগত মান নষ্ট করছেন। কিছু ব্যবসায়ী দুধের পরিবর্তে গুঁড়া দুধ, স্টার্চ এবং অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান মিশিয়ে দই তৈরি করছেন। এতে দইয়ের স্বাদ ও গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে।
এসআর/জেআইএম