যে কাউকে আ’লীগের দোসর বলে হয়রানি করেন এসআই আনিছ

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি কুষ্টিয়া
প্রকাশিত: ০১:১৬ পিএম, ১৮ মার্চ ২০২৫

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের তেকালা পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ (এসআই) আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে। কুষ্টিয়া মডেল থানায় নানা অপকর্মের কারণে তাকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয় তেকালা ক্যাম্পে। কিন্তু সেখানে যোগদান করেই সাধারণ মানুষকে জিম্মি, মাদককারীদের সঙ্গে আঁতাত করে মাসোহারা আদায়, মাদক দিয়ে ব্যবসায়ীদের ফাঁসানো, চাকরিজীবী ও সাধারণ মানুষের তালিকা বানিয়ে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যায়িত করে বাড়িঘরে অভিযানের নামে চাঁদাবাজির বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এসব বিষয় নিয়ে স্থানীয় এলাকাবাসী পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পর মিরপুর সার্কেল অফিসকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তদন্ত থেকে বাঁচতে বিভিন্ন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

পুলিশের কাছে দেওয়া অভিযোগ ও হয়রানির শিকার একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে আনিছের অপকর্মের নানা ফিরিস্তি উঠে এসেছে। আনিছের হয়রানি ও আক্রোশের শিকার হন মোটর মেকানিক স্বপন হোসেন।

গত ১০ মার্চ বিকেল ৫টা ৪৯ মিনিটের দিকে মোটর মেকানিক ধর্মদহ গ্রামের রফিকুল ইসলামের ছেলে স্বপনের কাছে আসেন তেকালা পুলিশ ক্যাম্পের কনস্টেবল সোহেল। একটি ব্যাগে ১০ বোতল ফেনসিডিল নিয়ে এসে স্বপনকে বিক্রি করে দেওয়ার জন্য চাপ দেন। বলেন, স্যার (আনিছ) বলেছেন এগুলো বিক্রি করে দিতে হবে, জরুরি টাকা লাগবে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

স্বপন ফেনসিডিল বিক্রি করতে রাজী না হলে জোরাজুরি করতে থাকেন সোহেল। পরে স্বপন তার ব্যবহৃত মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে যান। রাস্তায় ধর্মদহ মোড়ে দারোগা আনিছ তার অনুগত তরিকুল ও সোহেলসহ আরও কয়েকজনকে দেখে ভয়ে মোটরসাইকেল ফেলে রেখে পালিয়ে যান। পরে স্বপনের মোটরসাইকেল ক্যাম্পে নিয়ে আসেন আনিছ। এরপর তার কাছে ৫০ হাজার টাকা ও ১০ বোতল ফেনসিডিলের মূল্য দাবি করেন। পরে ভয়ে স্বপন ৩০ হাজার টাকা দিতে রাজী হন।

এর আগেও গত শবে বরাতের দিন মাংস কেনার জন্য টাকা দাবি করলে ৫ হাজার টাকা দিতে গেলে না নিয়ে ফেরত দেন আনিছ। ধর্মদহ গ্রামের মাদককারবারি ও সোর্স জাহিদুল এবং রতনের মাধ্যমে টাকা দাবি করেন আনিস। জাহিদুল মাদককারবারিদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায় করেন।

স্বপনের সঙ্গে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি ভয়ে আনিছের বিরুদ্ধে কিছু বলতে রাজী হননি। তবে এটুকু বলেন, ‘পুলিশের লোকজন আমার দোকানে মাঝেমধ্যে কাজের জন্য আসে। তাদেরকে আমি চিনি। আমি কোনো কথা বলতে পারব না।’

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

এর আগে গত ১ ফেব্রুয়ারি দুপুর দেড়টার দিকে আনিছ সঙ্গীয় ফোর্স তরিকুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে গুড়ারপাড়া ডাংমড়কা মাঠের মধ্যে অভিযান চালিয়ে মাদক কারবারি উপজেলার প্রাগপুর পশ্চিমপাড়া এলাকার আমির হোসেনের ছেলে মোকলেছসহ দুইজনকে মোটরসাইকেলে মাদক বহনের সময় আটক করে। পরে গুড়ারপাড়া গ্রামের শাকিল নামের এক ব্যক্তির মধ্যস্থতায় এক লাখ টাকা নিয়ে দুইজনকে ছেড়ে দেয়। আর ১৭০ বোতল ফেনসিডিল জব্দ না দেখিয়ে প্রাগপুর এলাকার মাদক ব্যবসায়ী জুয়েলের কাছে প্রতি পিস ১ হাজার ১০০ টাকা বিক্রি করে দেন বলে স্থানীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

স্থানীয় এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দারোগা আনিছ এলাকায় আসার পর মাদক চোরাচালান ও অপরাধ বেড়েছে। তিনি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের তালিকা তৈরি করে আওয়ামী লীগ বলে হয়রানি করছেন। অথচ মাদক কারবারিদের সঙ্গে নিয়ে ঘোরেন। এলাকায় চরম চাঁদাবাজি করছে। মানুষ অতিষ্ঠ। শান্তি-শৃংখলা রক্ষার পরিবর্তে নিজেই শান্তি বিনষ্ট করছেন।

আনিছের বিরুদ্ধে উপজেলার মশাওড়া মধ্যপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জান মোহাম্মদকে হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন এই অভিযোগ এনে পরপর তিনদিন অভিযান চালান আনিছ।

বিজ্ঞাপন

২০১২ সালের আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন জান মোহাম্মদ। এরপর চাকরি হওয়ার পর রাজনীতি থেকে ইস্তফা দেন। ৫ আগস্টের পর বিএনপির একটি পক্ষ তার কাছে চাঁদা দাবি করে। পরে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে সেটি সমাধান করেন।

এরপর আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিটিতে তার নামে আছে এমন অভিযোগে তার বাড়িতে ৩ বার লোক পাঠান আনিছ। বিএনপির কয়েকজন নেতার মাধ্যমেও টাকা-পয়সা দাবি করেন। এরপর স্ট্রোক করেন শিক্ষক জান মোহাম্মদ। ভয়ে পালিয়ে আছেন। এ সময়ের মধ্যে তার মেয়ের সাড়ে ৪ বছরের সন্তান মারা গেছেন। এসব নিয়ে তিনি কষ্টে আছেন জানিয়ে বলেন, খুব বিপদে আছি। কোনো রাজনীতি না করেও এখন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।

এ নিয়ে এলাকার এক সাংবাদিক আনিছকে ফোন দিলে তিনি ক্ষুব্ধ হন। তিনি পরে ওই শিক্ষকের এক আত্মীয়ের কাছে খবর পাঠিয়ে বলেন, ‘৫০ হাজার টাকা দিলে কিছুই হবে না, আমি ধরলে দুই লাখের কমে কাজ হবে না। মাজায় রশি বেঁধে মামলায় ঢুকিয়ে দেব, কেউ বাঁচাতে পারবে না।’

বিজ্ঞাপন

এসআই আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্ত এবং তাকে তেকালা পুলিশ ক্যাম্প থেকে অপসারণের দাবিতে গত বৃহস্পতিবারও (৬ মার্চ) পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন এলাকাবাসী।

কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনের গোপনীয় শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, আনিছের বিরুদ্ধে সদরে থাকতে নানা অনিয়ম ও অপকর্মের অভিযোগ ছিল। এরপর তাকে তেকালা পাঠানো হয়। নতুন করে অভিযোগ এসেছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে।

এদিকে অভিযোগ থেকে বাঁচতে আনিছ নানা দেন-দরবার ও তদবির শুরু করেছেন। এলাকার সাবেক এক চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন বিএনপি নেতাকে সঙ্গে নিয়ে সার্কেল ও এসপি অফিসে ঘুরছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়ার বিষয়ে জান মোহাম্মদকে সন্দেহ করেন। এরপর তিনি জান মোহাম্মদ ও তার পরিবারকে নানাভাবে হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন। এছাড়া তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত মিরপুর সার্কেলের রিডার এসআই রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ উঠেছে। আনিছের বন্ধু হওয়ায় তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন তিনি। আনিছের হয়ে কৈফিয়ত লিখে দিয়েছেন এই এসআই রেজা।

বিজ্ঞাপন

অভিযোগের বিষয়ে জানতে এসআই আনিছের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমিও একজন মানুষ। দোষ, গুণ থাকবেই। তবে কেউ বলতে পারবে না আমি মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে একটি লজেন্স খেয়েছি। আওয়ামী লীগের পদধারী লোকজন ও মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করার জন্য আমাকে পাঠানো হয়েছে।’

কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, আনিছের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে।

আল-মামুন সাগর/এফএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।