শূন্য থেকে সফল উদ্যোক্তা অনার্স পড়ুয়া রিংকি

একজন সফল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার পেছনে থাকে ছোট ছোট অনেক গল্প, অক্লান্ত পরিশ্রম এবং ধৈর্য ধারণের পরীক্ষা। স্বপ্ন পূরণের পথে আসে নানান বাধা, কিন্তু সব বাধা অতিক্রম করে আত্মবিশ্বাসের সাথে যারা এগিয়ে যান সফলতা তাদেরই ধরা দেয়। তেমনই একজন সফল উদ্যোক্তা বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষের মেধাবী শিক্ষার্থী রিংকি আক্তার।
রিংকি ধুনট উপজেলার চান্দিয়ার গ্রামের প্রান্তিক কৃষক আয়নাল হোসেনের মেয়ে। মা তারাভানু গৃহিণী। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে রিংকি তৃতীয়। আয়নাল-তারাভানু দম্পতি ছেলে সন্তানের আশায় পর পর তিন কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। এরমধ্যে রিংকি তৃতীয় সন্তান। কন্যাসন্তান হওয়ায় রিংকির বাবার মন খারাপ হয়। তাই বাবার অনাদরে বেড়ে উঠতে থাকেন রিংকি। মা তাকে ব্র্যাক পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। পঞ্চম শ্রেণি পাস করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু হয় তার জীবনযুদ্ধ। পরিবার থেকে খরচ বহন না করায় তার লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।
এ অবস্থায় স্থানীয় এক জালি টুপি ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ওই ব্যবসায়ী গ্রামীণ নারীদের হাতে তৈরি নামাজি জালি টুপি ক্রয় করে ঢাকার মোকামে বিক্রি করতেন। ২০১৬ সালের কথা। রিংকি তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন। ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বাকিতে ১৫০ পিস টুপি তৈরির সুতা কিনে নেন। সেগুলো গ্রামীণ নারীদের কাছে বিক্রি করে তার লাভ হয় ৭৫০ টাকা। লাভের টাকা রেখে ব্যবসায়ীর সুতার দাম পরিশোধ করে ফের বাকিতে সুতা কিনে একইভাবে নারী কারিগরদের কাছে বিক্রি করেন। পাশাপাশি মায়ের কাছ থেকে শিখে নিজেও শুরু করেন টুপি তৈরির কাজ। এ ভাবে নিজের আয়ের টাকায় লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকেন রিংকি। মূলত নিজের আত্মবিশ্বাস আর প্রবল ইচ্ছাশক্তি কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
আরও পড়ুন
- দুঃখের সাগরে থেকেও হাসিমুখে দিন-রাত কাজ করছেন প্রতিবন্ধী সালমা
- নারীদের পণ্যে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার সংগ্রামী গল্প
২০২০ সালে বৈশ্বিক মহামারি করোনায় যখন গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভঙ্গুর, দেশে করোনার প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ায় বন্ধ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ঘরে বসে অলস সময় পার করতে হচ্ছিল শিক্ষার্থীদের। কিন্তু এই অলস সময়কেই হাতিয়ার বানিয়ে নিজেকে তৈরি করেন একজন উদ্যোক্তা হিসেবে। প্রতিকূলতা জয় করে সফল উদ্যোক্তার ভূমিকায় নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন তিনি।
লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এরই মধ্যে তিনি চারটি ইলেক্ট্রিক জুকি ও কাটিং মেশিন এবং পাঁচটি ইস্ত্রি কিনে নিজ বাড়িতে স্থাপন করেছেন। সেখানে টি-শার্ট তৈরির কাজ করা হচ্ছে। ফ্যাশন মার্ট নামে এই কারখানায় সাতজন বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এছাড়া গ্রামে গ্রামে তার ৫০০ জনের অধীক নারী কারিগর রয়েছেন। যাদের দিয়ে তিনি হস্তশিল্পের কাজ করাচ্ছেন। তিনি স্কুটি চালিয়ে গ্রামীণ নারীদের হস্তশিল্পের কাজ তদারকি করেন।
শিক্ষাপ্রাতিষ্ঠান বন্ধের সেই সময়টা খুব মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন। ইউটিউব দেখে নতুন ব্যবসার চিন্তা করেন। তারপর উদ্যোক্তা বিষয়ক একটি ফাউন্ডেশনের অনলাইন গ্রুপে জয়েন হন। সেখানে যুক্ত হওয়ার পর তিনি সফল উদ্যোক্তাদের গল্প শুনে অনুপ্রাণিত হন। তিনি নিজের তৈরি বাহারি ডিজাইনের নামাজি জালি টুপি অনলাইনে বিক্রি শুরু করেন। এভাবেই একজন পূর্ণ উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন। এরপর আর পেছনে ফিরে দেখতে হয়নি তাকে। কুশিকাটার নামাজি টুপির সঙ্গে একে একে যুক্ত করেন নিজের হাতে তৈরি কুশন কভার, টেবিল ম্যাট ও গ্লাস ম্যাট। এই চারটি পণ্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সৌদি আরব ও দুবাইয়ে রপ্তানি করছেন।
লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এরইমধ্যে তিনি চারটি ইলেক্ট্রিক জুকি ও কাটিং মেশিন এবং পাঁচটি ইস্ত্রি কিনে নিজ বাড়িতে স্থাপন করেছেন। সেখানে টি-শার্ট তৈরির কাজ করা হচ্ছে। ফ্যাশন মার্ট নামে এই কারখানায় সাতজন বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এছাড়া গ্রামে গ্রামে তার ৫০০ জনের অধীক নারী কারিগর রয়েছেন। যাদের দিয়ে তিনি হস্তশিল্পের কাজ করাচ্ছেন। তিনি স্কুটি চালিয়ে গ্রামীণ নারীদের হস্তশিল্পর কাজ তদারকি করেন। শূন্য পুঁজি থেকে লাখপতি হয়ে ওঠা সফল এই উদ্যোক্তা এবছর বেগম রোকেয়া দিবসে অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী হিসেবে উপজেলা প্রশাসন থেকে জয়িতা সন্মাননা পেয়েছেন। এছাড়া উদ্যোক্তা বিষয়ক একটি ফাউন্ডেশন থেকেও তাকে সন্মাননা দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে একজন নারী শুধু চাকরির বাজারে নয়, বরং নিজে উদ্যোক্তা হয়ে অন্যেরও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন। নারীর মুক্তির পথ তৈরি হয় আর্থিক সচ্ছলতায়। ভবিষ্যতে নিজেকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখি। আমি নিজের চেষ্টায় আত্মনির্ভরশীল হয়েছি, নানান প্রতিবন্ধকতা থাকার পরও। আমি চাই, নিজের একটি প্রতিষ্ঠান হবে এবং প্রতিষ্ঠানে বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেব।
আরও পড়ুন
- ছন্নছাড়া জীবন ছেড়ে ১৮ বেদে নারীর রূপান্তরের গল্প
- ছুটি বিহীন চাকরি সফলভাবে সামলে নিচ্ছেন গেটম্যান লতা
সফল উদ্যোক্তা রিংকি আক্তার বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে একজন নারী শুধু চাকরির বাজারে নয়, বরং নিজে উদ্যোক্তা হয়ে অন্যেরও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন। নারীর মুক্তির পথ তৈরি হয় আর্থিক সচ্ছলতায়। ভবিষ্যতে নিজেকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখি। আমি নিজের চেষ্টায় আত্মনির্ভরশীল হয়েছি, নানান প্রতিবন্ধকতা থাকার পরও। আমি চাই, নিজের একটি প্রতিষ্ঠান হবে এবং প্রতিষ্ঠানে বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেব। বেকারত্ব দূর করার জন্য এই অবদানটুকু রাখতে চাই।
ধুনট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খৃষ্টফার হিমেল রিছিল বলেন, রিংকি আক্তারের সফল উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প শোনার জন্য তার বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে তার কর্মযজ্ঞ পরিদর্শন করে মুগ্ধ হয়েছি। প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকলে সফল হওয়া যায় রিংকি তার অনন্য দৃষ্টান্ত। তাকে সরকারিভাবে সহযোগিতা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
এলবি/এসএইচএস/জেআইএম