পরচুলায় হাসি-খুশির সফলতায় ভাগ্য বদলেছে শত নারীর

পরিত্যক্ত ময়লা ও উষ্কখুষ্ক চুল শ্যাম্পু, ব্লিচিং পাউডার এবং কন্ডিশনার দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার ও প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি হচ্ছে ফ্যাশনেবল পরচুলা। যাচ্ছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে, ব্যাপকহারে আয় হচ্ছে দেশি ও বিদেশি মুদ্রা। এভাবেই সাফল্য এসেছে পাবনার চাটমোহরের উদ্যোক্তা হাসি ও খুশি নামে দুই বোনের। এ যেন পরিত্যক্ত ময়লা চুলে নিজেদের ফকফকে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণ। তাদের সফলতায় ভাগ্য বদলেছে একই গ্রামের শত অসহায় দরিদ্র নারী ও শিক্ষার্থীর।
হাসি ও খুশি উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের মস্তালীপুরের মেয়ে। তাদের পুরো নাম তাজনাহার হাসি ও আরজিনা আক্তার খুশি। উভয়েই বিবাহিত। স্বামী নিয়ে খুশি গাজীপুরে ও হাসি থাকেন কাটাখালী গ্রামের শ্বশুরবাড়ি। এ গ্রামেই গড়ে তুলেছেন পরচুলা তৈরির কারখানা।
১৫ বছরের ব্যবধানে এ কারখানাস্থলে হাসি ও খুশি এখন গড়েছেন তিনতলা বিশাল বাড়ি। এ বাড়ির তৃতীয় তলায় স্থাপন করা হয়েছে পরচুলা তৈরির কারখানা। নাম দিয়েছেন হেয়ার ফ্যাশন। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তোলা এ কারখানায় এখন কাজ করছেন দুই শতাধিক কর্মী। যে হাসি-খুশির ব্যক্তিগত প্রয়োজনে হাত পাততে হতো স্বামীর কাছে তারাই এখন প্রতি মাসে শ্রমিকদের অন্তত ৪ লাখ টাকার পারিশ্রমিক দেন।
হাসি-খুশির কারখানায় কর্মরত নারীরা-ছবি জাগো নিউজ
এ উদ্যোক্তারা জানান, ২০১০ সালে মাত্র ১০ জন কর্মী দিয়ে টিনের দোচালা ঘরে এ কারখানার কার্যক্রম শুরু করেন। ব্যাপক সফলতায় ১৫ বছরের ব্যবধানে এ কারখানাস্থলে হাসি ও খুশি এখন গড়েছেন তিনতলা বিশাল বাড়ি। এ বাড়ির তৃতীয় তলায় স্থাপন করা হয়েছে পরচুলা তৈরির কারখানা। এর নাম দিয়েছেন হেয়ার ফ্যাশন। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তোলা এ কারখানায় এখন কাজ করছেন দুই শতাধিক কর্মী। যে হাসি-খুশির ব্যক্তিগত প্রয়োজনে হাত পাততে হতো স্বামীর কাছে তারাই এখন প্রতি েমাসে শ্রমিকদের অন্তত ৪ লাখ টাকার পারিশ্রমিক দেন।
আরও পড়ুন
- দুঃখের সাগরে থেকেও হাসিমুখে দিন-রাত কাজ করছেন প্রতিবন্ধী সালমা
- নারীদের পণ্যে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার সংগ্রামী গল্প
হাসি বলেন, দুই বোনের বিয়ে হয় চাটমোহর উপজেলার কাটাখালীর একই বাড়ির আপন দুই ভাইয়ের সঙ্গে। বড় বোন খুশির স্বামী ঢাকায় পরচুলা তৈরির কাজ করতেন। তার থেকে এ কাজ শেখেন খুশি। এরপর খুশি হাসিকে শেখালে গ্রামের বাড়িতে অন্যদের প্রশিক্ষণ দেন হাসি। আশপাশের কয়েকজনকে প্রশিক্ষিত করার পর দোচালা টিনের ঘরে ১০ জন কর্মী দিয়ে শুরু করেন কারখানার যাত্রা। শুরুতে দেশীয় কয়েকটি কোম্পানির অর্ডারে কাজ করলেও পরে সেটি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও। প্রথমে ভারত দিয়ে শুরু হলেও এখন পাকিস্তান, আজারবাইজান, সিঙ্গাপুর ও সুইজারল্যান্ডসহ মোট ১১টি দেশে রপ্তানি হয় হাসি-খুশির কারখানা হেয়ার ফ্যাশন থেকে তৈরি পরচুলা। তৈরি হয় মনো, স্কিন, অক্টোকন ও ফুলক্যাপসহ বিভিন্ন ধরনের পরচুলা। প্রতি মাসে এখান থেকে ডেলিভারি হয় ৭০০-৮০০ পরচুলা। প্রাথমিকভাবে এ কারখানায় নেটে (জাল) পরচুলা বসানোর পর এগুলো যায় গাজীপুরের কারখানায়। সেখান থেকে প্রক্রিয়াজাত হয়ে ডেলিভারি হয় বিভিন্ন দেশে।
খুদে শিক্ষার্থীদেরও কাজ করতে দেখা যায় পরচুলা কারখানায়-ছবি জাগো নিউজ
হাসি বলেন, গুটিকয়েক কর্মীকে শিখিয়ে পড়িয়ে শুরু করা পরচুলা তৈরির কারখানা এখন দুই শতাধিকের পরিবার। এদের অধিকাংশই স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থী। গাজীপুরে আমাদের আরেকটি কারখানা রয়েছে, চাইলে সেখানে এ কারখানা স্থানান্তর করা যায়। কিন্তু স্থানীয় এই শিক্ষার্থী ও অন্য নারীদের কথা চিন্তা করে সেটি করা হয় না। এ কারখানার মাধ্যমে যেমন আমাদের দুই বোনের ভাগ্য বদলেছে, আমি চাই এর সঙ্গে অন্যদেরও ভাগ্য বদলাক।
আরও পড়ুন
- ছন্নছাড়া জীবন ছেড়ে ১৮ বেদে নারীর রূপান্তরের গল্প
- ছুটি বিহীন চাকরি সফলভাবে সামলে নিচ্ছেন গেটম্যান লতা
তিনি বলেন, প্রথমে ঢাকায় পরচুলা বিক্রেতাদের কাছ থেকে তিন হাজার টাকায় প্রতি কেজি চুল কেনা হয়। সেই চুল ব্লিচিং, শ্যাম্পু, গ্লিসারিন, কন্ডিশনার দিয়ে পরিষ্কার করে রোদে শুকানো হয়। এরপর চুল বান্ডিল করা হয়। এরপর নেটের (জাল) ক্যাপে সুচ দিয়ে চুল বুনিয়ে পরচুলা তৈরি করা হয়। বর্তমানে পুরুষের জন্য পরচুলা তৈরিতে প্রায় দেড় হাজার টাকা খরচ হয়, যা বিক্রি হয় ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায়। একইভাবে নারীদের জন্য লম্বা পরচুলা প্রস্তুত করতে ব্যয় হয় ১৬ হাজার টাকা, এর বিপরীতে বিক্রি হয় ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকায়। আমরা এখন এ সেক্টরে প্রতিষ্ঠিত। সফলতার জন্য পরমুখাপেক্ষী না থেকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, ধৈর্য ও একাগ্রতায় চেষ্টা করলেই হয়। নারী বলে পিছিয়ে থাকার এখন কোনো সুযোগ নেই বলেও জানান তিনি।
এ কারখানায় শুধু হাসি ও খুশির ভাগ্য বদলায়নি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ায় কাজ করে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ খুঁজে পেয়েছেন গ্রামের সাধারণ হতদরিদ্র নারীরা। লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছেন নারী শিক্ষার্থীরাও। নারীদের আর্থিক সচ্ছলতা সমাধান দিয়েছে গ্রামের অনেক সামাজিক সমস্যারও।
শুরুতে দেশীয় কয়েকটি কোম্পানির অর্ডারে কাজ করলেও পরে সেটি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও। প্রথমে ভারত দিয়ে শুরু হলেও এখন পাকিস্তান, আজারবাইজান, সিঙ্গাপুর ও সুইজারল্যান্ডসহ মোট ১১টি দেশে রপ্তানি হয় হাসি-খুশির কারখানা হেয়ার ফ্যাশন থেকে তৈরি পরচুলা। তৈরি হয় মনো, স্কিন, অক্টোকন ও ফুলক্যাপসহ বিভিন্ন ধরনের পরচুলা। প্রতি মাসে এখান থেকে ডেলিভারি হয় ৭০০-৮০০ পরচুলা।
এ ব্যাপারে অনার্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী তানজিলা তাবাসসুম তিথি বলেন, এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে দরিদ্র মানুষের বাস। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানো প্রয়োজন জেনেও অনেকে আর্থিক দৈন্যের কারণে সেটি পারেন না। ফলে পড়ালেখা বন্ধ করে অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায় অভিভাবকদের মধ্যে। কিন্তু এ কারখানা স্থাপনের পর সেটি অনেকাংশেই কমেছে। মেয়েরা নিজের টাকায় পড়াশোনা করছে। আমি নিজেও করছি। এ কারখানায় শুধু হাসি ও খুশি আপুর ভাগ্য বদলায়নি। আশপাশের কয়েকটি এলাকার দরিদ্র অসহায় ও স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদেরও ভাগ্য বদলেছে।
পরচুলা বানিয়ে পড়ার খরচ চালাচ্ছেন নারী শিক্ষার্থীরা-ছবি জাগো নিউজ
উপজেলার চড়াইকোল গ্রাম থেকে পরচুলা তৈরি কাজে এসেছেন মুনিয়া খাতুন। তিনি স্থানীয় বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তিন বছর ধরে এ কাজে নিয়োজিত জানিয়ে মুনিয়া বলে, লেখাপড়ার পাশাপাশি অবসর সময়ে এ কাজ করি। এর মধ্য দিয়ে আমরা আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছি। এখন আর বই-খাতা, প্রাইভেট খরচ ও অন্য আনুষঙ্গিক খরচের জন্য বাড়িতে কারও কাছে হাত পাততে হয় না। উল্টো পরিবারকে সাহায্য করতে পারি।
আরও পড়ুন
শিক্ষার্থী আল্পনা খাতুন ও রেশমা জানান, সাধারণত একটি ছোট পরচুলা তৈরিতে দুই থেকে আড়াই দিন ও বড়টি তৈরিতে তিন থেকে চার দিন সময় লাগে। কাজের দক্ষতার ওপর কারও কম বা বেশিও লাগে। ছোট বা মাঝারি প্রতি পরচুলায় ৫০০ থেকে ৭০০ ও বড় প্রতিটি তৈরিতে ৯৫০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পাই। সবমিলিয়ে এ কারখানা থেকে মাসে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা আয় হয়। এ দিয়ে আরামে লেখাপড়া ও নিজের প্রয়োজন মেটে। এখন আর আমরা পরিবারের বোঝা নই।
গুটিকয়েক কর্মীকে শিখিয়ে পড়িয়ে শুরু করা পরচুলা তৈরির কারখানা এখন দুই শতাধিকের পরিবার। এদের অধিকাংশই স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থী। গাজীপুরে আমাদের আরেকটি কারখানা রয়েছে, চাইলে সেখানে এ কারখানা স্থানান্তর করা যায়। কিন্তু স্থানীয় এই শিক্ষার্থী ও অন্য নারীদের কথা চিন্তা করে সেটি করা হয় না। এ কারখানার মাধ্যমে যেমন আমাদের দুই বোনের ভাগ্য বদলেছে, আমি চাই এর সঙ্গে অন্যদেরও ভাগ্য বদলাক।
গৃহবধূ কোহিনুর বেগম বলেন, এই বাজারে একজন আয় করে সংসার চালানো কঠিন। তাই ভাবলাম অলস বসে না থেকে কাজ করি। এখান থেকে যা আয় হচ্ছে তা দিয়ে ছেলেপেলের বই, খাতা-কলম কেনাসহ টুকটাক খরচ মিটে যাচ্ছে। স্বামীকেও সহযোগিতা করতে পারছি। এখানে কয়েকজন স্বামী পরিত্যক্ত আছে, তারা আর পরিবারের কাছে বোঝা নয়। কাজ করে আয় করে। নিজের খরচ নিজে মেটায়।
এত সফলতার মাঝেও কারখানায় যাতায়াতের সড়কের বেহাল দশাকে একমাত্র সংকট হিসেবে দেখছেন কর্মীরা। বর্ষা মৌসুমে নারী কর্মীদের যাতায়াত কাদা পানিতে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন তারা কাজে আসতে পারেন না। এসময় যাতায়াত সহজ করতে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের দাবি জানান তারা।
আরও পড়ুন
স্থানীয় সমাজকর্মী ইশারত আলী বলেন, দুই বোনের এই উদ্যোগ আমাদের পুরো গ্রাম বদলে দিয়েছে। এলাকার গরিব নারীরা আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পথ খুঁজে পেয়েছেন। সামাজিক পারিবারিক নির্যাতন কমে গেছে। শিক্ষার হার বেড়েছে। আমরা গ্রামবাসী হাসি খুশির জন্য গর্ব করি। তাদের কারখানার রাস্তাটি পাকাকরণ হলে, গ্রামের আরও নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
এএইচআইএন/এসএইচএস/জেআইএম