গারো পাহাড়ে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব চরমে

শেরপুরের গারো পাহাড়ে মানুষের সঙ্গে বন্যহাতির দ্বন্দ্ব দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। বনাঞ্চল উজাড়, বসতির সম্প্রসারণ ও খাদ্যের অভাবে হাতির দল লোকালয়ে নেমে আসছে, নষ্ট করছে ফসল ও বাড়িঘর। ক্ষুব্ধ কৃষকরা নিজেদের সম্পদ রক্ষায় ফাঁদ হিসেবে বিদ্যুতের জিআই তার ব্যবহার করছেন, যার ফলে একের পর এক হাতি মারা পড়ছে। আবার ক্ষিপ্ত হাতির আক্রমণে প্রাণ হারাচ্ছেন এলাকাবাসী।
একের পর এক হাতির মৃত্যু ঘটলেও প্রশাসন কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। হাতির আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষায় সরকারের গৃহীত সোলার ফেন্সিং প্রকল্পও ব্যর্থ হয়েছে। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে অবৈধভাবে বিদ্যুতের ফাঁদ ব্যবহার করছে, যা হাতির মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে।
‘মানুষ মারা গেলে কোনো সহযোগিতা ঠিকভাবে পাই না, উল্টো হাতির কিছু হলে মামলা হয় আমাদের নামে’
পরিবেশবিদরা বলছেন, হাতির নিরাপদ অভয়ারণ্য এবং পর্যাপ্ত খাবারের অভাবই এই সংঘাতের মূল কারণ।
আর স্থানীয়দের দাবি, হাতির আক্রমণে তাদের জীবিকা ও বসতবাড়ি হুমকির মুখে পড়েছে। প্রশাসনের উদ্যোগ ও যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে এই সংকট দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
এক সময় গারো পাহাড়ের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল ছিল হাতির অবাধ বিচরণভূমি। তবে সময়ের সঙ্গে বনভূমি দখল ও কৃষিজমিতে রূপান্তরের ফলে হাতির স্বাভাবিক বাসস্থান সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ১৯৯৫ সালে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড় থেকে দলছুট হয়ে আসা প্রায় ২০-২৫টি হাতি গারো পাহাড়ে প্রবেশ করে। বর্তমানে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০-৭০টিতে। কিন্তু তাদের বসবাসের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই, নেই পর্যাপ্ত খাদ্যও। ফলে তারা বাধ্য হয়ে গ্রাম ও চাষের জমিতে হানা দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হাতির এই অস্বাভাবিক অভিবাসনের পেছনে অন্যতম কারণ হলো বন উজাড় ও পাহাড়ি এলাকায় বসতির সংখ্যা বৃদ্ধি। শেরপুরের সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলায় গারো, কোচ, ডালু, বানাই ও হদি আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন। সময়ের সঙ্গে তাদের সংখ্যা বেড়েছে এবং বনভূমি দখল করে বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। এতে বনাঞ্চল সংকুচিত হয়ে হাতির আবাসস্থল প্রায় ধ্বংসের পথে। ফলে হাতির দল বাধ্য হয়ে মানুষের এলাকায় আসছে, আর সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে।
‘বনাঞ্চল সংকুচিত হয়ে হাতির আবাসস্থল প্রায় ধ্বংসের পথে। ফলে হাতির দল বাধ্য হয়ে মানুষের এলাকায় আসছে’
শেরপুরের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ রয়েছে, ভারতীয় সীমান্তের বাসিন্দারা ফসল রক্ষা করতে বন্যহাতির দলকে তাড়িয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এতে শেরপুরের সীমান্ত এলাকায় হাতির উপস্থিতি বেড়েছে এবং তারা বেঁচে থাকার জন্য মানুষের ফসল খেতে বাধ্য হচ্ছে।
- আরও পড়ুন
- শেরপুরে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব মিটবে কিসে?
- সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকলো পাঁচ বন্যহাতি
- টেকনাফে পাহাড়ে বন্যহাতির মৃত্যু
সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামবাসীদের মতে, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বনাঞ্চল উজাড় হওয়ায় হাতিরা খাদ্যের সন্ধানে বাংলাদেশে চলে আসছে। তবে এই বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
মানুষের সঙ্গে হাতির সংঘাত সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ নেয় যখন কৃষকরা ফসল রক্ষায় বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে রাখেন। সর্বশেষ গেলো বছরের অক্টোবরে নালিতাবাড়ীর গারো পাহাড়ের সীমান্তবর্তী পোড়াগাঁও ইউনিয়নের বাতকুচি গ্রামে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে মৃত্যু হয়েছে এক বন্যহাতির। এভাবে গত এক দশকে শেরপুরের সীমান্ত এলাকায় ২৯টি হাতি মারা গেছে, যার বেশিরভাগই বিদ্যুতের ফাঁদে আটকে বা গর্তে পড়ে। বিপরীতে হাতির আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন ৩৫ জন মানুষ। তবে এ পর্যন্ত হাতি হত্যার ঘটনায় মাত্র দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা অঞ্জনা মারাক বলেন, হাতি আমাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দিচ্ছে, ফসল খেয়ে ফেলছে। কিন্তু প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয় না। আমরা কি হাতির জন্য ক্ষতি সহ্য করবো?
চন্দন হাজং বলেন, প্রতি বছরই ধানের মৌসুম এলেই হাতি আমাদের ফসল নষ্ট করে। তাদের প্রতিহত করতে গেলে মারা যায় স্থানীয় মানুষও। অথচ এখন এ দেশে মানুষের চেয়ে হাতির প্রতি দরদ বেশি দেখানো হয়। মানুষ মারা গেলে কোনো সহযোগিতা ঠিকভাবে পাই না, উল্টো হাতির কিছু হলে মামলা হয় আমাদের নামে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, শেরপুরের উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সঙ্গে সরাসরি সীমান্ত রয়েছে। ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দারা ফসল রক্ষার জন্য হাতির দলকে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে তাড়িয়ে দেয়। ফলে এই বন্যহাতিরা বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।
এদিকে হাতির আক্রমণ প্রতিরোধে সরকার কয়েক বছর আগে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সোলার ফেন্সিং প্রকল্প চালু করেছিল, যা বিদ্যুৎচালিত বৈদ্যুতিক ফেন্সিংয়ের তুলনায় নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব। কিন্তু সঠিক তদারকির অভাবে এ প্রকল্প কার্যকর হয়নি।
কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, সোলার ফেন্সিং ব্যবস্থার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ না করায় এটি অকেজো হয়ে পড়েছে। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে অবৈধ বিদ্যুতের তার ব্যবহার করছে, যা একদিকে হাতির প্রাণহানি ঘটাচ্ছে, অন্যদিকে মানুষের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, বন উজাড়ের কারণে হাতি লোকালয়ে আসছে। ফলে দ্বন্দ্ব বাড়ছে এবং মানুষ হাতির ওপর প্রতিশোধ নিতে বাধ্য হচ্ছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘শাইন’র সভাপতি মুগনিউর রহমান মনি বলেন, হাতির জন্য অভয়ারণ্য ও পর্যাপ্ত খাদ্যের ব্যবস্থা করা না হলে এই সংঘাত চলতেই থাকবে। বন উজাড় বন্ধ করতে হবে এবং হাতির স্বাভাবিক চলাচলের পথগুলো সংরক্ষণ করতে হবে।
পরিবেশবিদরা মনে করেন, হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে হাতির প্রাকৃতিক আবাসস্থল সংরক্ষণ, বনাঞ্চল উজাড় বন্ধ করা এবং হাতির জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যের ব্যবস্থা করা জরুরি। পাশাপাশি সীমান্তবর্তী এলাকায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে হাতির চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা দরকার।
জনউদ্যোগ শেরপুরের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, হাতি হত্যার জন্য দায়ীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে হাতির অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ নালিতাবাড়ীর ঘটনায় বন বিভাগ ১১ জনকে স্বনামে এবং অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছে।
শেরপুরের সহকারী বন সংরক্ষক মো. সাদেকুল ইসলাম খান বলেন, আমরা হাতি হত্যা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি। দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে স্থায়ী সমাধানের প্রয়োজন বলে মনে করেন শেরপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা বিএনপির সভাপতি মো. মাহমুদুল হক রুবেল।
তিনি বলেন, হাতির জন্য আলাদা অভয়ারণ্য ও পর্যাপ্ত খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ ছাড়া এই সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।
এফএ/জিকেএস