কৃষকের গলায় আলুর ফাঁস

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক বগুড়া
প্রকাশিত: ১২:২৬ পিএম, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

উত্তরের জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলু উৎপাদন হয় বগুড়া ও জয়পুরহাটে। গত বছর কৃষক অনেক বেশি দাম পেলেও এবার পড়েছেন সংকটে। বাজারে আলুর দাম এতটাই কম যে উৎপাদন খরচও উঠছে না। অন্যদিকে হিমাগারে সংরক্ষণের সুযোগ থাকলেও হঠাৎ ব্যয়বৃদ্ধির ঘোষণায় সেই পথও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

ক্ষুব্ধ কৃষকরা বলছেন, সিন্ডিকেট করে তাদের গলায় এই ফাঁস পরানো হচ্ছে। কারণ এখন প্রতিকেজি আলুতে তাদের লস হচ্ছে ৫ টাকার কাছাকাছি। সেখানে অতিরিক্ত মূল্যে সেই আলু হিমাগারে রাখলে তাদের সর্বনাশ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আর এতে করে এই মৌসুমে শুধু এই দুই জেলায় হিমাগার কর্তৃপক্ষের কাছে বাড়তি দিতে হবে ৩০০ কোটি টাকা।

বিজ্ঞাপন

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবার জয়পুরহাটে ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে চাষ হয়েছে ৪৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। এ থেকে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯ লাখ ৩১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন।

কৃষকের গলায় আলুর ফাঁস

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আর বগুড়ায় এ বছর ৫৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল প্রায় ১২ লাখ মেট্রিক টন। ভালো ফলন হওয়ায় এখানে লক্ষ্যমাত্রার বেশি আলু মিলবে। তবে আশানুরূপ ফলন হলেও বাজারমূল্য কম থাকায় কৃষকরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।

কৃষকদের দাবি, এবার প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ হয়েছে ১৪ থেকে ১৬ টাকা। জমি চাষ, বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ ও শ্রম খরচ মিলিয়ে এক বিঘা জমিতে আলু চাষ করতে তাদের ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু ক্ষেত থেকে এখন আলু বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১০ থেকে ১২ টাকা কেজিতে। যা উৎপাদন খরচের চেয়েও কম। স্বাভাবিক কারণেই শুরুর মৌসুমেই প্রত্যেক কৃষককে ব্যাপক লোকসান গুণতে হচ্ছে।

হিমাগার মালিকরা জানান, বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলায় ৫৫টি হিমাগার রয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত ধারণক্ষমতা প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। আগামী ২০ ফেব্রুয়ারির পর থেকে আলু সংরক্ষণ শুরু হবে। মৌসুমে ১০-১২ দিনেই একটি হিমাগার আলুতে ভরে যায়। এত অল্প সময়ে ২ লাখ টন আলু মাপা সম্ভব নয়। কিন্তু বের করা হয় আস্তে আস্তে। কোনো কোনো হিমাগার থেকে আলু বের হতে ৬ থেকে ৮ মাসও লাগে। তাই এবার হিমাগারের ভাড়া নির্ধারণ করা হবে আলু বের করার সময়। গত বছরও আলু রাখার সময় ভাড়া নেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দিয়েছে। অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুশান্ত কুমার প্রামাণিক স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, হিমাগারের বিপরীতে নেওয়া ঋণের সুদ, বিদ্যুৎ খরচ, লোড-আনলোডিং ও পাল্টানোর খরচ, কর্মচারীদের বেতন, বোনাস, বিমা খরচ, গ্যাস বিল, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ বিশ্লেষণ করে প্রতি কেজি আলুর সংরক্ষণ ব্যয় দাঁড়ায় ৯ টাকা ৬২ পয়সা। তারপরও ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে কেজি প্রতি ৮ টাকা।

একইসঙ্গে তারা বলছে, গত বছর ব্যাংক সুদের হার ছিল ৯-১০ শতাংশ। এ বছর তা বেড়ে ১৬-১৭ শতাংশ হয়েছে। যদিও বিদ্যুতের বিল অপরিবর্তিত রয়েছে। আগে ৭০-৮০ কেজির প্রতিবস্তা আলুর ভাড়া ছিল ৩২০-৩৫০ টাকা। আর এবার প্রতি বস্তায় ৫০ কেজি বেশির আলু রাখা যাবে না। ভাড়া পড়বে ৮ টাকা হিসেবে ৪০০ টাকা।

জানা গেছে, দুই জেলায় এবার আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ২১ লাখ ৩১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। কেজির হিসাবে যার পরিমাণ হয় ২১ কোটি ৩১ হাজার ৫০০ কেজি। এরমধ্যে হিমাগারের ধারণক্ষমতা অনুসারে ৭ লাখ ৫০ হাজার টন (৭৫ কোটি কেজি) আলু রাখা হলে কেজি হিসাবে ৪ টাকা বাড়তি ধরা হলে ৩০০ কোটি টাকা বেশি লাগে।

বিজ্ঞাপন

শেরপুর উপজেলার কৃষক আব্দুল কাদের বলেন, এক বিঘা জমিতে ৮০-৯০ মণ আলু হয়। যদি প্রতি কেজি ১০-১২ টাকা দরে বিক্রি করি, তাহলে পুরো মৌসুমের খরচই উঠবে না, লাভতো দূরের কথা। আবার আলু ক্ষেতে বিক্রি না করে যে হিমাগারে রাখবো, সেই সুযোগও বন্ধ করা হয়েছে। এবার হিমাগারগুলো আলু সংরক্ষণের খরচ দ্বিগুণ করে ৪ টাকা থেকে ৮ টাকা কেজি করেছে। বিদ্যুতের দাম না বাড়লেও সংরক্ষণ ব্যয় বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক বলছেন তারা।

জয়পুরহাটের কৃষক আকরাম হোসেন বলেন, হিমাগার মালিকরা গত বছরও জোটবদ্ধ হয়ে ভাড়া বৃদ্ধি করেছিল। এবারও তারা ভাড়া বৃদ্ধি করেছে। আমরা মাঠে ঘাম, শ্রম ঝড়িয়ে ফসল ফলিয়ে টাকা লস করবো আর তারা বসে থেকে সেই ফসলের ফায়দা লুটবে। এটি সিন্ডিকেট ছাড়া আর কিছুই নয়। এভাবে চলতে থাকলে আলুর মৌসুম চলে গেলেই সংকটের প্রভাব বাজারে পড়বে।

বটতলী বাজার এলাকার ব্যবসায়ী বেলাল হোসেন বলেন, হিমাগার ভাড়া যতই বাড়বে, ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া হয়ে উঠবে। আর এর চাপ পড়বে ভোক্তাদের ওপর। প্রশাসনের এখনই হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। আর এই দুই জেলায় প্রয়োজনের তুলনায় হিমাগারের সংখ্যা কম। এ কারণে মালিকরা সিন্ডিকেট করার সুযোগ পাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

জয়পুরহাটের কৃষক কামাল হোসেন বলেন, যখন আমরা আলু বিক্রি করি, তখন দাম থাকে না। পরে যখন দাম বাড়ে, তখন মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভ করে। এখন হিমাগারেও রাখতে পারছি না, কারণ ঘোষিত ভাড়ায় আলু রাখা সম্ভব নয়।

কৃষকের গলায় আলুর ফাঁস

শিবগঞ্জের কৃষক রহিম উদ্দিন বলেন, আগে ৪ টাকা কেজি হিমাগার ভাড়া দিয়ে সংরক্ষণ করতাম, এখন ৮ টাকা। এত টাকা দিয়ে আলু রেখে পরে বিক্রি করলেও লাভ হবে না।

বিজ্ঞাপন

বগুড়া জেলা কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি আলহাজ তোফাজ্জল হোসেন জানান, হিমাগারে আলু রাখার ভাড়া নির্ধারণ করে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন। শ্রমিক খরচ ও বিদ্যুৎ খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এতে কৃষকের ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা নেই। কারণ বাজারে এখন দাম কম হলেও পরবর্তীতে দাম বেড়ে যায়।

জয়পুরহাট কৃষি বিপণন অধিদফতরের কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন, সংরক্ষণ ভাড়া বাড়লে এর চাপ ভোক্তা পর্যায়ে পড়বে। সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীরা আলুর দাম বাড়িয়ে দেবেন। বিদ্যুতের দাম বাড়েনি, তবুও সংরক্ষণ খরচ বৃদ্ধির পুরো চাপ শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ওপর পড়ার সম্ভবনা থাকে। আমরা এই বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেছি। সব পক্ষের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলা হবে।

আব্দুল ওয়াহাব নামের আরও এক কর্মকর্তা বলেন, হিমাগার মালিকরা যদি প্রকৃত কৃষকদের জন্য ভাড়ার ব্যাপারে কিছু ছাড়ের ব্যবস্থা করেন এবং কৃষকদের বীজআলু সংরক্ষণের জন্য উৎসাহিত করেন, তাহলে পরবর্তী মৌসুমে বীজ আলুর সংকট কমবে। গত বছর আমাদের সবার আলু নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। এবার আমাদের আগে থেকেই সাবধান হওয়া উচিত।

বিজ্ঞাপন

জেলা প্রশাসনের বাণিজ্য শাখার শিল্প ও বাণিজ্য বিভাগ হিমাগার বা কোল্ড স্টোরেজের লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন করে থাকে। আর পরিচালনা নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।

বগুড়া জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজা বলেন, আমরা দাম কমে যাওয়া এবং বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে বাজার মনিটরিং করছি এবং প্রয়োজনে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখনকার সমস্যা নিয়ে হিমাগার মালিকদের সঙ্গেও কথা বলা হবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করার দরকার ছিল।

এফএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।