ইতালির জন্য ‘গেম’ দিয়ে নিখোঁজ কুদ্দুস, নিঃস্ব হয়েছে পরিবার

অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়েছেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার কুদ্দুস বেপারী (৩২)। বাড়ি থেকে যাত্রা করার আগে দালালকে লিখে দিয়েছেন দুই বিঘা জমি। এখন স্বামী আর জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন কুদ্দুসের স্ত্রী এবং একমাত্রা সন্তান। ইউরোপ যেতে পারলেই স্বপ্ন পূরণ, এমন আশায় বের নিখোঁজ কুদ্দুস বেপারী। আর দেশে দিশেহারা হয়ে পড়েছে তার পরিবার।
নিখোঁজ কুদ্দুস বেপারী মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার মজুমদারকান্দি গ্রামের আতাহার বেপারী ও শান্তি বেগমের ছেলে। তিনি বাংলাদেশে ছিলেন মোবাইল মেকানিক।
স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ইতালি নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে একই গ্রামের দালাল মনির শেখ (৫০) ২ বিঘা জমি লিখে নেন কুদ্দুস বেপারীর কাছ থেকে। ওই জমির মূল্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা। পরে গত চার মাস আগে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হন কুদ্দাস। বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় গিয়ে বন্দি থাকেন এক জায়গায় যাকে দালালদের ভাষায় বলা হয় ‘গেম ঘর’। সম্প্রতি লিবিয়ায় নৌকাডুবির ঘটনার পর থেকে কুদ্দুস বেপারী নিখোঁজ। ওই ঘটনার পর থেকে পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই তার। তিনি জীবিত নাকি মৃত, কিছুই জানে না কেউ।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, দালাল মনির শেখ দুই বছর আগেও দর্জির কাজ করতেন। এরপর বিভিন্ন যুবকদের প্রলোভন দেখিয়ে অবৈধপথে ইতালি নেওয়ার কাজ শুরু করেন। তার মাধ্যমেই ইতালি যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হন কুদ্দুস বেপারী।
কুদ্দুস বেপারীর স্ত্রী দিনা আক্তার বলেন, তিন বছর আগে আমাদের বিয়ে হয়। আমাদের সংসারে আট মাস বয়সের একটি ছেলে আছে। হঠাৎ দালাল মনিরের প্রলোভনে পড়ে প্রায় ৬০ লাখ টাকা দামের ২ বিঘা জমি গোপনে লিখে দেয় আমার স্বামী। আমরা কিছুই জানতাম না। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আমার স্বামী জানায়, মনির দালালের মাধ্যমে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাচ্ছে। ৪ মাস লিবিয়ায় ছিল। তখন তার সঙ্গে কথা হয়েছে। কিন্তু গত প্রায় ১৪ দিন কোনো কথা হয় না। তার কোনো খোঁজও পাচ্ছি না। এদিকে দালালও পালিয়ে গেছে, তারও ফোন বন্ধ।
দিনা আক্তার বলেন, একপর্যায়ে জানতে পারি গত ২৪ জানুয়ারি নাকি লিবিয়ার বেনগাজি থেকে ৪৩ জনের গেম দিয়েছে, তাতে অনেকেই মারা গেছে। অনেকেই নিখোঁজ। সেদিন থেকেই আমার স্বামীরও কোনো খোঁজ নেই। এখন আমার ছেলেকে নিয়ে আমি কীভাবে বাঁচবো? দালালের কঠোর বিচার চাই।
নিখোঁজ কুদ্দুসের অসহায় স্ত্রী-সন্তান
নিখোঁজ কুদ্দুস বেপারীর ভাই সোবহান বেপারী বলেন, আমার ভাইকে ইতালি নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ২ বিঘা জমি লিখে নিয়েছে মনির দালাল। আমার বাবা ও আমাকে ভাই কিছুই জানায়নি। সর্বশেষ ২২ জানুয়ারি আমার ভাই আমাদের জানিয়েছিল, গেম দেবে তাই তার ফোন নিয়ে যাবে। এরপর থেকে কোনো কথা হয়নি। গেম দেওয়ার কথা ছিল ২৫ জানুয়ারি। কিন্তু কবে গেম দিয়েছে, আমার ভাই বেঁচে আছে কি না, কিছুই জানি না। আর কোনো যোগাযোগ নেই। দালালও ফোন বন্ধ করে গা ঢাকা দিয়েছে। আমরা কী করবো, জানি না। দালাল মনিরের বিচার চাই।
নিখোঁজ কুদ্দুস বেপারীর মা শান্তি বেগম বলেন, আমার ছেলে কাউকে কিছু না জানিয়ে দালাল মনিরকে ২ বিঘা জমি লিখে দিয়েছে। আমরা এর কিছুই জানতাম না। হঠাৎ একদিন বলে আমি ইতালি যাই। লিবিয়া হয়ে ইতালি যাবো। আমাদের আর কোনো দুঃখ থাকবে না। কিন্তু আমার ছেলের সঙ্গে বর্তমানে কোনো যোগাযোগ নেই। আমার ছেলে বেঁচে আছে কি না তাও জানি না। আমি মনির দালালের বিচার চাই, ছেলের সন্ধান চাই।
মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মো. সাইফুজ্জামান বলেন, এ বিষয়ে ভুক্তভোগী পরিবার চাইলে মামলা করতে পারেন। আমরা তাদের সহযোগিতা করবো। মানবপাচারকারীদের গ্রেফতারে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। এছাড়া অবৈধভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আর কেউ যেন না যান, সে বিষয়ে আমরা সচেতনতামূলক সভা করছি।
এ ব্যাপারে দালাল মনির শেখের মোবাইল বন্ধ পাওয়ায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তাছাড়া তার বাড়িও তালাবদ্ধ পাওয়া গেছে।
আয়শা সিদ্দিকা আকাশী/এমএইচআর/এমএস