জাবি ছাত্রদলের রাজনীতিতেও সেশনজটের শঙ্কা
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটগুলোতে কমিটি গঠন শুরু করেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। এতে আট বছর অপেক্ষার পর কমিটি গঠন নিয়ে আশার আলো দেখছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) শাখা ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। এরইমধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে কমিটি না থাকায় নতুন কমিটিতে অছাত্রদের প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতার কারণে ছাত্র রাজনীতিতেও রয়েছে সেশনজটের শঙ্কা।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৫৩তম ব্যাচ (২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষ) থেকে ৪৭তম ব্যাচ (২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ) অধ্যয়নরত। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জাবিতেও গঠিত হবে আহ্বায়ক কমিটি। তবে আসন্ন কমিটিতে থাকবেন ৩৯তম ব্যাচ ও ৪০তম ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থীরা। অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের একাডেমিক গ্যাপ প্রায় ৭ থেকে ১০ বছরের মতো। এতে জাবি ছাত্রদলের রাজনীতিতে সেশনজট সৃষ্টির আশঙ্কা করেছেন বর্তমান শিক্ষার্থীরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের রাজনীতিতে সাবেকদের প্রভাব স্পষ্ট। জাবি শাখা ছাত্রদলের রাজনীতিতে পাঁচটি গ্রুপ থাকলেও সাবেক নেতাদের কেন্দ্র করে বর্তমানে দুইটি গ্রুপে বিভক্ত। একটি গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শাখা ছাত্রদল সভাপতি ও যুক্তরাজ্য বিএনপির বর্তমান সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পারভেজ মল্লিক এবং আরেকটি অংশসহ বাকি চারটি গ্রুপের যারা পারভেজ মল্লিকের বিরোধী। পারভেজ মল্লিক গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন শাখা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম সৈকত। সৈকত সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ায় তার বলয় থেকে পদপ্রত্যাশী সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী নাইমুল হাসান কৌশিক এবং দর্শন বিভাগের ৪৬ ব্যাচের মুরাদ হাসান।
বাকি চারটি গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রদলের সাবেক দপ্তর সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি জিয়াউর রহমান, শাখা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আহসান অভি, শাখা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা, শাখা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মো. জাকিরুল ইসলাম জাকির। এদের মধ্যে জিয়া গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন রসায়ন বিভাগের ৩৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রদলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জহির উদ্দিন মো. বাবর, নাজমুল গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন মার্কেটিং বিভাগের একই ব্যাচের শিক্ষার্থী শাহ মো. ফয়সাল হোসেন, সোহেল রানা গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী জাকিরুল ইসলাম এবং জাকির গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শাখা ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি নবীনুর রহমান নবীন। এছাড়া পদ প্রত্যাশীদের দৌড়ে আছেন ইতিহাস বিভাগের ৪০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রদলের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজির হলের যুগ্ম আহ্বায়ক হুমায়ুন হাবীব হীরণ, ৩৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রদলের শহীদ সালাম-বরকত হলের যুগ্ম আহ্বায়ক আফফান আলী।
দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রদলের রাজনীতি করা নেতাকর্মীরা জানান, বিগত সরকারের শাসনামলে কেন্দ্র ঘোষিত বিভিন্ন কর্মসূচি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলো বাস্তবায়নে অধিকাংশ সময় সৈকত গ্রুপকে দেখা গেছে। হরতাল-অবরোধসহ সব কর্মসূচি পালন করেছেন তারা। এমনকি অবরোধ কর্মসূচির অংশ হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি গেটে একই সময়ে তালা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে অবরুদ্ধ করে রাখেন পারভেজ মল্লিকের অনুসারীরা, যা দেশব্যাপী আলোচনার জন্ম দেয়।
তবে পরভেজ মল্লিকের স্ত্রীর বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে, যদিও তিনি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রবাসে বিএনপি’র রাজনীতিতে জড়িত আছেন। এছাড়া অন্য গ্রুপগুলোর মধ্যে কিছু কর্মসূচিতে বাবর গ্রুপকে দেখা গেছে। তবে বাবরের বিরুদ্ধে শহীদ সালাম বরকত হল ছাত্রলীগ করার অভিযোগ আছে। ছাত্রলীগের পদ পদবি না পেয়ে ছাত্রদলের রাজনীতিতে ভিড়াসহ কয়েকটি বিষয়ে গত ৯ ডিসেম্বর ২০২০ সালে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি বরাবর আবেদনপত্র দেন শাখা ছাত্রদল নেতৃবৃন্দ। এছাড়া ৫ আগস্টের আগে শাখা ছাত্রদলের অন্যান্য গ্রুপের কোনো ধরনের কর্মসূচি চোখে পড়েনি বলে জানান তারা।
আফফান আলী এবং নবীনুর রহমান নবীন গ্রুপে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অনুপ্রবেশের অভিযোগ আছে। এছাড়া শাখা ছাত্রদলের গত কমিটির সভাপতি সোহেল রানার বিরুদ্ধে অনাস্থা জ্ঞাপন করেছিলেন শাখা ছাত্রদলের দশ নেতা। এর মধ্যে ছিলেন নবীনুর রহমান নবীন ও শাহ মো. ফয়সাল হোসেন।
এ বিষয়ে আফফান আলী বলেন, আমি ছাত্রলীগ দ্বারা নির্যাতিত। তাদেরকে দলে নিয়ে রাজনীতি করার প্রশ্নই ওঠে না। তবে অনেকে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করবে, এছাড়া রাজনীতির মাঠে অনেকে ব্লেইম গেম খেলার চেষ্টা করবে। ছাত্রলীগের সঙ্গে কোনো আপস নয়, এছাড়া অন্যান্য সংগঠন থেকেও কেউ যদি অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করে তাদের প্রতিহত করা হবে। এছাড়া বর্তমানে আমার সঙ্গে যারা আছে তাদের মধ্যে কেউ ছাত্রলীগের অনুপ্রবেশকারী নয়।
নবীনুর রহমান নবীন বলেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে অনেকেই আমাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছে। আমরা আমাদের হাইকমান্ডের নির্দেশে সর্বোচ্চ যাচাই বাছাই করার চেষ্টা করছি, যাতে ছাত্রলীগ করা বা দলছুট বিতর্কিত কেউ যেন চূড়ান্তভাবে জায়গা না পায়। এটা নিশ্চিত হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না।
জাবি ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠনের দায়িত্ব পাওয়া কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহইয়া বলেন, এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখনো কমিটির বিষয় চূড়ান্ত হয়নি। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাহিদা, আন্দোলনে ভূমিকা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রাখা নেতৃবৃন্দকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সোহেল-সৈকতের নেতৃত্বে ১৯ সদস্যবিশিষ্ট জাবি ছাত্রদলের কমিটি গঠিত হয়। এরপর থেকে জাবিতে আর কোনো কমিটি গঠিত হয়নি।
এফএ/এমএস