লিটনের লালসার শিকার হয়ে হাতছাড়া রাবির জন্মস্থান ‘বড়কুঠি’
রাজশাহী অঞ্চলের সর্বপ্রাচীন ইমারত বড়কুঠি। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে নির্মিত এই ভবনটি এক সময় ছিল ডাচদের ব্যবসা কেন্দ্র। পরে ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে পাকিস্তান সরকার এই বড়কুঠি এবং এর সম্পত্তি রাজশাহী বিশ্বাবদ্যালয়কে অর্পণ করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পৃথক স্থাপনা নির্মাণের আগ পর্যন্ত এই বড়কুঠি ছিল ভাইস চ্যান্সেলরের বাসভবন ও কার্যালয়। নীচতলা কার্যালয় ও ওপর তলা বাসভবন।
পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ক্যাম্পাস নির্মিত হলে দীর্ঘদিন বড়কুঠির নিচতলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়ক কর্মচারী ইউনিয়নের অফিস ও ওপরতলা টিচার্স ক্লাব হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু কালের পরিক্রমায় বড়কুঠি এখন আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেই। রাবির জন্মস্থান এখন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মালিকানাধীন। কিন্তু এমন মালিকানা মানতে নারাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মস্থান বিশ্ববিদ্যালয়কে ফিরিয়ে দিতে সরকারের কাছে জোর দাবি তাদের।
অনুসন্ধান সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মস্থান বড়কুঠির উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব দিকে তৎসংলগ্ন কিছু ফাঁকা জায়গার ওপর নজরে পড়ে তৎকালীন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনের। যেগুলো ছিল জমিদারদের প্রোপার্টি। এগুলো দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করে ফ্ল্যাট আকারে বিক্রি করাই ছিল লিটনের মূল উদ্দেশ্য। ২০০৯-২০১৩ মেয়াদে মেয়র থাকাকালীন বড়কুঠিকে রাজশাহীর সিটি মিউজিয়াম গড়ার লক্ষ্যে তৎকালীন রাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুস সোবহানকে রাসিকের অর্থায়নে এটি সংস্কারের প্রস্তাব দেন মেয়র লিটন। কিন্তু সেই প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
রাসিক মেয়রের প্রস্তাবটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে উঠলে সকল সদস্য এ প্রস্তাবটিকে নাকচ করেন। এ নিয়ে শুরু হয় খায়রুজ্জামান লিটনের চক্রান্ত। তৎকালীন সরকারের প্রভাবশালী এমপি-মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের প্রভাব খাটিয়ে গোপনে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে নিয়ে নেন এই বড়কুঠি। এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতছাড়া হয়ে যায় বড়কুঠি।
২০১৮ সালের মে মাসে বড়কুঠিকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ সরকার। প্রথম পর্যায়ে ৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকার সংস্কারকাজ করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। এরইমধ্যে বড়কুঠিকে একটি প্রকল্পের আওতায় আনে সরকার। সেই প্রকল্পের মাধ্যমে বৃহৎ পরিসরে সংস্কার, সংরক্ষণ ও জাদুঘর করা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
এদিকে সরকার পরিবর্তনের পর থেকে নিজেদের জন্মস্থান বড়কুঠি ফিরে পেতে অন্তর্বর্তী সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বড়কুঠিকে নিজেদের মালিকানাধীন করতে প্রয়োজনে আন্দোলনেও নামবেন বলে জানান তারা।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকরা বলছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় জন্মস্থান এই বড়কুঠিকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবেগ-অনুভূতি জড়িয়ে আছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কিভাবে রাবি সম্পদের মালিকানা লাভ করে? সাবেক রাসিক মেয়র ও বিগত সরকারের একটি মহল কারসাজি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে বড়কুঠি কেড়ে নিয়েছে। তবে এখন সময় এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মস্থান বিশ্ববিদ্যালয়কে ফিরিয়ে দেওয়ার। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন তারা।
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. শাকিল আলী বলেন, বড়কুটি যে আমাদের জন্মস্থান, আমরা সেটাই ভুলে গিয়েছিলাম। কারণ আমাদেরকে বড়কুঠি সম্পর্কে জানতে দেওয়া হয়নি। বড়কুঠি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে পূণ্যভূমির মতো। কিন্তু কোনো এক চক্রান্ত গোষ্ঠীর প্রভাবে আমরা আমাদের জন্মস্থানকে নিজের বলে পরিচয় দিতে পারছি না। রাবির কাছ থেকে বড়কুঠি ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে রাবির প্রতিষ্ঠালগ্ন বড়কুঠি ফিরে পেতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।
লোক প্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আল-মামুন বলেন, বড়কুঠি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ, এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য বহন করে। বড়কুঠি ছাড়া রাবি শিক্ষার্থীরা এক ধরনের এতিম, কারণ আমাদের কোনো জন্মস্থান নেই। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মিউজিয়াম করতে পারলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কি পারতো না এটিকে মিউজিয়াম হিসেবে ব্যবহার করতে। তাই সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ রাবির সম্পদ রাবিকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। নাহলে আমরা আন্দোলনে বসতেও পিছুপা হবো না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ও সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য ড. আমজাদ হোসেন বলেন, আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ছিলাম, তখন বড়কুঠিকে সিটি মিউজিয়াম করতে সাবেক রাসিক মেয়র ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু ওই যাত্রায় রাবি শিক্ষকদের সহযোগিতায় রাসিক মেয়রের জবরদখল ঠেকানো সম্ভব হয়। তারপর হঠাৎ একদিন শুনি এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মালিকানায় চলে গেছে। আমার শিক্ষার্থীরা নিজেদের জন্মস্থানের পরিচয় দিতে পারবে না, তা কখনোই হতে পারে না। বড়কুঠি দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল। যতদিন এ বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে ততদিন বড়কুঠি নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গর্ব করবে। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে বড়কুঠিকে আবারো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা শিক্ষা অনুষদের সাবেক ডিন ও মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ফরিদুল ইসলাম বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম-ইতিহাসের সঙ্গে বড়কুঠি নামটি ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। অথচ এই প্রাচীন গৌরবোজ্জ্বল স্থাপনাটি তৎকালীন উপাচার্য অত্যন্ত সংগোপনে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিকট হস্তান্তর করেন যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ গোটা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতার শামিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অবশ্যই এই প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ রক্ষক, তবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ ইঞ্চি পরিমাণ সম্পত্তিও কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দেওয়ার অধিকার রাখেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনাটি অনতিবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট ফিরিয়ে দেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ইতিহাস রয়েছে সেটির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হচ্ছে এ বড়কুঠি। আমিও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে থাকাটাই সবথেকে শ্রেয়। বড়কুঠি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি ল্যান্ডমার্ক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যে অভিপ্রায় আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করবো। বড়কুঠিকে রাবির অধীনে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রশাসন থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন বলে জানান তিনি।
মনির হোসেন মাহিন/এফএ/জেআইএম