ছাত্র আন্দোলন
বাবা পঙ্গু, পুলিশের গুলিতে পঙ্গু হওয়ার পথে ছেলে মোস্তাকিমও
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ২০ জুলাই বিকেলে সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে বাইরে বের হন মো. মোস্তাকিম (১৮)। ওইসময় কারফিউ চলছিল। গাজীপুরে কারফিউ ভেঙে হঠাৎ রাস্তায় নেমে আসেন আন্দোলনকারীরা। পুলিশ তখন আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে নির্বিচার গুলি ছুড়তে থাকে। এসময় দৌড়ে পালাতে গিয়ে একটি গুলি লাগে মোস্তাকিমের পায়ে।
গুলিটি তার হাঁটুর একপাশ দিয়ে লেগে অপর পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। উপস্থিত বন্ধুরা মোস্তাকিমকে উদ্ধার করে নিয়ে যান স্থানীয় একটি হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে তাকে রেফার করেন চিকিৎসক। দেশের পরিস্থিতি খারাপ থাকায় পায়ে ব্যান্ডেজ করে কোনোরকম চিকিৎসা দিয়েই পরদিন তাকে বিদায় দেওয়া হয়।
গাজীপুরের বাসায় এক সপ্তাহ বিশ্রাম নেন মোস্তাকিম। চিকিৎসক জানিয়েছেন, গুলিতে মোস্তাকিমের পায়ের রগ ছিঁড়ে গেছে। ক্ষত শুকানোর পর অপারেশন করতে হবে। এ কথা শুনে গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার সাতুর গ্রামে তাকে নিয়ে আসেন স্বজনরা। সেই থেকে ব্যান্ডেজ প্যাঁচানো পা নিয়ে বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন মোস্তাকিম। দরিদ্র পরিবারটি চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। মোস্তাকিম নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার সাতুর গ্রামের বাচ্চু মিয়ার ছেলে।
চার ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয় মোস্তাকিম। বাবা বাচ্চু মিয়া ২০১৩ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় এক পা ভেঙে পঙ্গু হয়েছেন। অভাবের পরিবার। তাই ভাঙা পা নিয়েই বাড়ির পাশে ছোট একটি টং দোকান চালান তিনি। সম্পদ বলতে বাড়ির ১২ শতাংশ জায়গা ছাড়া কিছুই নেই। মোস্তাকিমের বড় ভাই মিজানুর বিয়ের পর সংসার থেকে আলাদা হয়ে গেছেন। তার ছোট দুই ভাই পড়াশোনা করে।
পাশের আটপাড়া উপজেলার একটি কওমি মাদরাসা থেকে ২০২২ সালে হেফজ সম্পন্ন করেন মোস্তাকিম। তারপর রোজাগারের খোঁজে গাজীপুর শহরে চলে যান। সেখানে গিয়ে একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার আয় দিয়ে ভালোই চলছিল পরিবারের ভরণপোষণ আর ছোট ভাইদের পড়াশোনা। কিন্তু গুলিতে আহত হয়ে বিছানায় শুয়ে গুনতে হচ্ছে চিকিৎসা খরচ। তার উপার্জন বন্ধ হওয়ায় কষ্টে দিনযাপন করছেন পরিবারের সদস্যরা।
মোহনগঞ্জের সাতুর গ্রামে মোস্তাকিমদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পায়ের নিচে বালিশ রেখে বারান্দায় খাটের ওপর আধা শোয়া অবস্থায় আছেন মোস্তাকিম। পুরো পায়ে ব্যান্ডেজ। ঘর থেকে বারান্দা পর্যন্তই তার চলাফেরার সীমানা। লাঠিতে ভর দিয়েই এটুকু জায়গা চলতে হয় তার।
ওইদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে হাফেজ মোস্তাকিম বলেন, ‘আন্দোলনের কারণে কয়েকদিন ধরেই কারখানা বন্ধ ছিল। এ অবস্থায় আবার কারফিউ চলছিল। দরকারি জিনিসপত্র কেনার জন্য ২০ জুলাই বিকেল ৩টার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত দেখে বাসা থেকে বের হই। গাজীপুর শহরের বড়বাড়ি মোড়ে যেতেই হঠাৎ কোথায় থেকে আন্দোলনকারীরা চলে আসে। মুহূর্তে তাদের দিকে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে পুলিশ। আমার পাশে দুজন গুলিতে মারা যায়। আরও অনেকের হাতে-পায়ে গুলি লাগে। পরিস্থিতি খারাপ দেখে দৌড় দিই। তখনই একটি গুলি এসে আমার পায়ের হাঁটু বরাবর লাগে।’
তিনি বলেন, ‘গুলিটি পায়ের একপাশে লেগে অন্যপাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। তখনই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে জ্ঞান হারাই। পরে বন্ধুরা তুলে আমাকে হাসপাতালে নেয়। সেখানে গিয়ে জ্ঞান ফিরে দেখি হাসপাতালে অনেক আহত লোকজন। অনেকে মারা গেছে।’
মোস্তাকিম আরও বলেন, ‘প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েই পঙ্গু হাসপাতালে রেফার করে আমাকে। পঙ্গুতে গিয়েও দেখি অনেক রোগী। সেখানে ব্যান্ডেজ করে একদিন রেখেই বিদায় করে দেয়। বাসায় এসে এক সপ্তাহ বিশ্রাম নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে আসি। চিকিৎসক জানিয়েছেন, গুলিতে পায়ের রগ ছিঁড়ে গেছে। আপাতত পায়ের ক্ষত শুকাতে হবে। পরে আবার গিয়ে অপারেশন করাতে হবে।’
মোস্তাকিমের মা পুষ্পা আক্তার বলেন, ‘স্বামী ২০১৩ সাল থেকে পঙ্গু হয়ে আছেন। এ অবস্থায় পেটের দায়ে সামান্য একটা টং দোকান চালান। এটাতে তেমন আয় নেই। বড় ছেলে বিয়ের পর আলাদা হয়ে গেছে। মোস্তাকিমই পরিবারের একমাত্র অবলম্বন। ছোট দুইটা ছেলের পড়াশোনা, পরিবারের সবার খরচ সবই সামলাতো মোস্তাকিম। বাড়ির জায়গাটা ছাড়া আর কোনো জমিজমা নেই। এ অবস্থায় ছেলের চিকিৎসা কীভাবে করাবো?’
তিনি বলেন, ‘ঋণ করে চিকিৎসা করাচ্ছি। আর কতদিন চিকিৎসা করাতে পারবো জানি না। আমার ছেলেটা তো জীবনে কারও কোনো ক্ষতি করেনি। তার ওপর কেন এই বিপদ এলো’ কার কাছে এর বিচার দেবো?’
মোস্তাকিমের বাবা বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘একমাত্র উপার্জনশীল ছেলেটা আহত হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। আমি নিজেও পঙ্গু। ঋণ করে চিকিৎসা খরচ চালাচ্ছি। কয়দিন পর আবার অপারেশন করাতে হবে। অনেক টাকা খরচ হবে। কীভাবে কী করবো বুঝতে পারছি না।’
এইচ এম কামাল/এসআর/জিকেএস