ছাত্র ফ্রন্ট
বুয়েটের উন্নয়ন প্রকল্পে ভাগ বসাতেই ছাত্রলীগের হঠাৎ তৎপরতা
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) উন্নয়ন প্রকল্পের ভাগ নিশ্চিত করতেই হঠাৎ ছাত্রলীগ সেখানে ছাত্ররাজনীতি চালু করতে তৎপর হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট।
বুধবার (৩ এপ্রিল) সন্ধ্যায় সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ ও সাধারণ সম্পাদক রায়হান উদ্দিন এক যৌথ বিবৃতিতে এমন মন্তব্য করেন।
বিবৃতিতে ছাত্র ফ্রন্ট নেতারা বলেন, ‘২০১৯ সালে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের মাধ্যমে একদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আপাত প্রশমিত করা হয় এবং সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সেফ এক্সিট তৈরি করে। কয়েকদিন আগে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে পুনরায় বুয়েট শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমে একই দাবি জানায়। দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামে অর্জিত ছাত্ররাজনীতিকে শাসক শ্রেণির দল কলুষিত করে আসছে। একদিকে রাজনীতির ওপর ছাত্র সমাজের বিরূপ ধারণা তৈরি করছে, অন্যদিকে তাদের নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য আদালতকেও ব্যবহার করেছে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চলার ঘোষণা দিয়ে। এতদিন নীরব থেকে কেন ছাত্রলীগ ঘটা করে ক্যাম্পাসে গেল? এর কারণ হিসেবে বিভিন্ন সূত্রে জানতে পরি সামনেই বুয়েটে বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করা হবে। অন্যসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই বুয়েটের এসব উন্নয়ন প্রকল্পে নিজেদের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিশ্চিত করতেই ছাত্রলীগের বর্তমান এই তৎপরতা বলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।’
ছাত্র ফ্রন্ট নেতারা বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি ছাত্রলীগের নেতাদের যাওয়াকে কেন্দ্র করে একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ করে এবং বুয়েটে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি চলবে না বলে তাদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে। ২০১৯ সালে ফেনী নদীর পানি ভারতকে দেওয়ার প্রতিবাদ জানিয়ে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা পিটিয়ে হত্যা করে। এর প্রতিবাদে তখন সাধারণ ছাত্ররা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলনে নামে। এক পর্যায়ে ছাত্ররা দাবি জানায় ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বুয়েট কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।’
সংগঠনটির শীর্ষ দুই নেতা বলেন, ‘হাইকোর্ট যেভাবে রিট হওয়ার দুই ঘণ্টার মধ্যে রকেটের গতিতে বুয়েট কর্তৃপক্ষের জারি করা প্রজ্ঞাপন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এতে জনমনে প্রশ্ন তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও অন্য নেতাদের বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চালুর মন্তব্যের পরই হাইকোর্টের এই রায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার চিত্রকেও আরেকবার দেশের মানুষের সামনে উন্মোচিত করলো। আবার বুয়েট শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ যে রকম ঢালাওভাবে সাম্প্রদায়িক শিবির কিংবা হিযবুত তাহরীর বলে প্রচার চালাচ্ছে তা তাদের পুরোনো ঘৃণ্য অপকৌশল ছাড়া কিছুই নয়। শাসক শ্রেণি ও সরকারের অগণতান্ত্রিক গণবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে যে কোন আন্দোলনকেই এইভাবে শিবির বলে দাগ করা বাস্তবে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী রাজনীতিরই অপকৌশল।’
আরও পড়ুন
- বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি চালু চায় ছাত্রলীগ, কী বলছে ছাত্রদল?
- রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের নিশ্চয়তা পেলে ক্লাসে ফিরবেন শিক্ষার্থীরা
- আজও পরীক্ষায় অংশ নেননি বুয়েট শিক্ষার্থীরা
মুক্তা বাড়ৈ ও রায়হান উদ্দিন বলেন, ‘২০১০ সালে ক্যম্পাসে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, অপরাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কারণে তৎকালীন বুয়েট শাখা সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের আহ্বায়ককে অমানবিক হামলার শিকার হতে হয়েছিল। ধারাবাহিক হামলা-নির্যাতনের মধ্য দিয়ে আবরার হত্যাকাণ্ডের অর্ধযুগেরও বেশি সময় আগে থেকেই অন্যান্য বাম প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের ওপর হামলা-নির্যাতন চালিয়ে ক্যাম্পাসে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিল ছাত্রলীগ। বাম প্রগতিশীল রাজনীতির এই শূন্যতা ও সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের একচ্ছত্র দখলদারত্বের বলি হতে হয়েছে আবরার ফাহাদকে। আবরার হত্যার পরপরই শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়লে আমরা সেই বিক্ষোভে সর্বাত্মকভাবে অংশ নিই। সেই আন্দোলনের মধ্যে সন্ত্রাস-দখলদারত্ব বিরোধী যে স্পিরিট ছিল আমরা তার সঙ্গে একমত ছিলাম, কিন্তু শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা অংশ দাবি তোলেন ছাত্র রাজনীতি বন্ধের। তখনই আমরা বলেছিলাম ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না।’
তারা আরও বলেন, ‘একটা দীর্ঘসময় ধরে ছাত্ররাজনীতি বলতে সাম্প্রদায়িক ছাত্র শিবিরের হাত-পায়ের রগ কেটে দেওয়া, ছাত্রদলের সন্ত্রাস এবং ছাত্রলীগের র্যাগিং, দখলদারত্ব, তোলাবাজি, সিট বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, জোরপূর্বক মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নেওয়ানো, গণরুম, গেস্টরুম ইত্যাদি চলে আসছে। এসব দেখে ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে সাধারণ ছাত্র সমাজের মধ্যে বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছে। যেটা শাসকশ্রেণিই দীর্ঘদিন ধরে চেয়ে আসছে। শিক্ষার্থীরাও শাসকদের এই অপকৌশল বুঝতে না পেরে আপাত সমাধান হিসেবে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছে। যা বুমেরাং হিসেবে বুয়েটের সংকটকে আরও গভীর করবে।’
ছাত্রনেতারা বলেন, ‘অন্যায়-জবরদস্তি ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন ও কেন্দ্রীভূত করার পাহারাদার হলো আওয়ামী লীগ। আর ছাত্রলীগ হলো তার সহায়ক পেটোয়া বাহিনী। ক্যাম্পাসগুলোতে ভিন্নমত ও দলের ওপর আক্রমণের মধ্য দিয়ে সেই শোষণ ও লুটপাটের পথ প্রশস্ত করাই শাসক শ্রেণির ছাত্র সংগঠনগুলোর রাজনীতি। এর বিপরীতের রাজনীতি হচ্ছে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, সাম্প্রদায়িকীকরণ, শিক্ষা সংকোচনসহ ছাত্র-শ্রমিক-কৃষকসহ আপামর মানুষের সংকট নিরসনের দাবিতে পরিচালিত রাজনীতি অর্থাৎ শোষণ-বৈষম্যহীন বাংলাদেশ তথা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার রাজনীতি।’
তারা বলেন, ‘অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন সম্পর্কিত যে প্রশ্ন উত্থাপনের জন্য আবরারকে জীবন দিতে হয়েছিল সেটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। একটি প্রশ্ন করার জন্য কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা খুবই পীড়াদায়ক। এ থেকে বোঝা যায় বিশ্ববিদ্যালয় হলো ছাত্র সমাজকে প্রশ্ন করতে শেখানো, কিন্তু স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকার মানুষকে প্রশ্ন করতে দেয় না। বাক স্বাধীনতা হরণ করে। ফলে বাক স্বাধীনতা হরণকারী সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সচেতন ও সংগঠিত উপায়ে সব ধরনের সন্ত্রাসী অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাই আজ সময়ের দাবি। তাই শাসকশ্রেণির রাজনীতির চিত্র দেখে ভীতসন্ত্রস্ত কিংবা বিমুখতা নয়, সুস্থ ও আদর্শভিত্তিক পাল্টা রাজনৈতিক শক্তিই পরিত্রাণের পথ তৈরি করবে।’
বিবৃতিতে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের নেতারা দেশের আপামর ছাত্রসমাজের কাছে আদর্শের সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান। তারা বুয়েটসহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত এবং অবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচনসহ শিক্ষার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ছাত্র-শিক্ষক, অভিভাবকসহ সর্বস্তরের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।
হাসান আলী/কেএসআর/জেআইএম