টিএসসির ইফতার যেন পরিবারের শূন্যতা পূরণ করে

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: ০৯:৩৭ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২৪
টিএসসিতে শিক্ষার্থীদের ইফতার আয়োজন/ছবি: জাগো নিউজ

ঘড়ির কাটা সাড়ে ৫টা বাজতেই বিভিন্ন হল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) হাজির হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। লাল ইটের ভবনগুলোর মাঝে সবুজ চত্বরে গোল হয়ে বসেন ইফতারের উদ্দেশ্যে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একত্রে ইফতার করেন এখানে। মাঠের মধ্যে ছোট ছোট দলে গোল হয়ে বসেন সবাই। কোনোটিতে তিনজন আবার কোনোটিতে ৩০ জন। সন্ধ্যা নামার আগেই এখানে সমাগম ঘটে এমন অর্ধ-শতাধিক দলের। কখনো কখনো আরও বেশি।

মুড়ি, ছোলা, খেজুর, জিলাপি, বেগুনি, পেঁয়াজু, চিকেন, পাকোড়া, বুন্দিয়া, আলুর চপের পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের পানীয়, শরবত, জুস, কলা, আপেলসহ নানা জাতের ফল থাকে শিক্ষার্থীদের ইফতারে। কেউ কেউ ভালো রেস্তোরাঁ থেকে আনিয়ে নেন বিরিয়ানি বা পোলাও। অনেকেই আবার ইফতার তৈরি করে আনেন বাসা বা হল থেকে।

ইফতার উপলক্ষে সন্ধ্যা নাগাদ মুখরিত হয়ে ওঠে টিএসসি এলাকা। টিএসসি এলাকা ছাড়াও ক্যাম্পাসের সড়কদ্বীপ, মিলন চত্বর, হাকিম চত্বর, রোকেয়া হলের সামনে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটক, সবুজ চত্বর, মলচত্বর, বিভিন্ন হলের মাঠসহ ক্যাম্পাসের আনাচে-কানাচে সরগরম হয়ে ওঠে ইফতার করতে আসা শিক্ষার্থীদোর পদচারণায়।

আরও পড়ুন

শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া তরুণ বা কর্মজীবী মানুষেরও ইফতারের প্রিয় স্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সবার উদ্দেশ্য সারাদিনের সিয়াম সাধনার পর বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আনন্দে ইফতার করা এবং ইফতারের পর একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া। পরিবার ছেড়ে উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে আসা শিক্ষার্থীরা বন্ধু-বান্ধব বা তাদের সিনিয়র-জুনিয়রদের মাঝেই পরিবারের আবহ খুঁজে পান।

এমন দৃশ্য ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রসহ ক্যম্পাসে নিয়মিত হলেও শুরুর দিকে এবার এই আয়োজনে কিঞ্চিৎ ভাটা পড়েছিল। দৃশ্যপট কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল প্রথম ১০ রমজান পর্যন্ত। সরকারিভাবে কৃচ্ছসাধনের নির্দেশনা, ইফতারের মাত্রাতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি, ইফতার নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনার কারণে লোকজনের কমতি ছিল। তবে রহমতের ১০ দিন পেরোতেই সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠে চিরচেনা রূপে আবার আবির্ভূত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রাঙ্গণ।

টিএসসির ইফতার যেন পরিবারের শূন্যতা পূরণ করে

সরেজমিনে টিএসসি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সবুজ ঘাসের ওপর খবরের কাগজ বিছিয়ে কেউ কেউ ইফতার প্রস্তুতে ব্যস্ত। আবার কেউ কেউ প্রস্তুত শেষে বসিয়েছে জমজমাট আড্ডা। খোলা মাঠের পাশাপাশি ইনডোরেও ইফতারের আয়জন করে থাকেন শিক্ষার্থীরা। মলচত্বরে শতবর্ষের স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির কারণে সবুজ চত্বরে কনস্ট্রাকশনের মালপত্র রাখা হলেও এর আশপাশ ঘিরেই বসেন শিক্ষার্থীরা।

টিএসসিতে ইফতার করতে এসেছেন সুমাইয়া, নাজিফা, মালিহা ও তারেক। তারা সবাই ভিন্ন ভিন্ন হলের কিন্তু একই বিভাগের বন্ধু। পাশাপাশি বসে ইফতার খবরের কাগজে ছোলা-মুড়ি মাখাচ্ছিলেন তারা। এ সময় কথা হয় তাদের সঙ্গে। তারা জানান, এই জায়গাটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই ভালো লাগার একটি জায়গা। এখানকার সামাজিক পরিবেশের জন্য অনেকেই এখানে ইফতার করতে আসতেন। আর বন্ধু-বান্ধব সবাই মিলে ইফতার করার মজাটাও অন্যরকম। সবাই মিলে ইফতার করতে বেশ ভালো লাগে। তাই সুযোগ পেলেই এখানে আসি। পরিবার ছেড়ে পরিবারের একটু স্বাদ পাওয়া যায় যেন এখানে।

শুধু বন্ধু-বান্ধব মিলেই নয়, টিএসসির মূল অডিটোরিয়াম, গেমস রুম, ক্যাফেটেরিয়া, কিংবা সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কার্যালয়েও নিয়মিত চলে নানা ধরনের ইফতার আয়োজন। এসবের আয়োজনে বিভিন্ন জেলা সংগঠন, টিএসসির সামাজিক সংগঠন ও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা থাকেন। অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনও এগুলো আয়োজন করে। পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে কিংবা রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর উদ্যোগেও মাসব্যাপী ইফতার ও সেহরি আয়োজন করা হয়। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-কর্মকর্তারা এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে ইফতার করতে আসেন এখানে।

আরও পড়ুন

২০১৫ সালে পাস করে বের হয়ে এখন ঢাকাতেই বিভিন্ন পেশায় কর্মরত আছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তাদের একজন রুবেল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ছাত্র জীবন অনেক মিস করি। চাকরিতে যোগদানের পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় অতীত হয়ে গেছে। সুন্দর কিছু স্মৃতি তৈরির জন্যই ক্যাম্পাসের ইফতার আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বন্ধুরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। চাকরির কারণে বাবা-মাও গ্রামের বাড়িতে। এখানে যে কয়েকজনকে একসঙ্গে পেয়েছি, আমার মনে হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বসেই ইফতার করছি। যদিও পরিবারের শূন্যতা পূরণ সম্ভব নয়, তবে মানসিক প্রশান্তিটা বড় বিষয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ইফতারের কাঁচামাল তথা পেঁয়াজু, বেগুনি, ছোলা-মুড়ি ইত্যাদি আসতো হলপাড়ার মিনি চকবাজার খ্যাত অস্থায়ী ইফতার বাজার থেকে। কিন্তু বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার কারণে সেই অস্থায়ী ইফতার বাজারও এবার বসেনি। যদিও টিএসসির কর্মচারীরা অস্থায়ীভাবে গেটের সঙ্গে একটি ইফতারের দোকান দিয়েছেন। কিন্তু সেটি পর্যাপ্ত নয় বলেই জানান শিক্ষার্থীরা।

সাব্বির রহমান নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, টিএসসির ইফতারের একটি দিক হলো এখানে ছিন্নমূল পথশিশুরাও সবার সঙ্গে খাবার খাওয়ার সুযোগ পায়। অনেকে আবার বিভিন্ন পাত্রে ইফতার সংগ্রহ করে পরিবারের জন্যও নিয়ে যায়। তাদের ইফতার সংগ্রহে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররাও বেশ সহানুভূতিশীল আচরণ করে। এটা অনেক মানবিক ও সুন্দর একটা বিষয়।

হাসান আলী/ইএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।