নির্বাচনহীন পাঁচ বছর, ফের অকার্যকর অধিকার আদায়ের ডাকসু
হাসান আলী
বাংলাদেশ সৃষ্টির আগে ও পরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দেশের মানুষের অধিকারের কথা বলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। দেশের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে ঢাবির শিক্ষক, শিক্ষার্থী এমনকি কর্মচারী পর্যন্ত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, লড়াই করেছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই অগ্রণী হয়ে করেছেন ভাষা আন্দোলন, দেশ স্বাধীনে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং হটিয়েছেন স্বৈরশাসন।
সবকিছুর পেছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক চর্চা। কিন্তু কালের পরিক্রমায় দিন দিন অতল গহ্বরে হারিয়েছে সেই চর্চা। আন্দোলন, লড়াই, সংগ্রামের ঐতিহ্য হারিয়েছে আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিক চর্চার সীমাবদ্ধতার ছাপ স্পষ্ট। ২৮ বছর পর ১১ মার্চ, ২০১৯ সালে সবশেষ ডাকসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) নির্বাচন হয়। এরপর আর কোনো নির্বাচন হয়নি। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের মতোই হল সংসদগুলোর অবস্থাও একই।
ডাকসুর অনুপস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর সহাবস্থান এবং ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখতে আশির দশকে গঠন করা হয়েছিল ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ পরিষদ’। পদাধিকারবলে উপাচার্য এর প্রধান এবং ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল তালিকাভুক্ত সব ছাত্র সংগঠনের শীর্ষ দুই নেতা, সিনেট, সিন্ডিকেট, শিক্ষক সমিতি ও প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রতিনিধিরা এই পরিষদের সদস্য।
দীর্ঘদিন ডাকসু কার্যকর না থাকায় এ পরিষদ ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠনগুলোর সহাবস্থান, গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতে ভূমিকা রেখে আসছিল। পরিবেশ পরিষদের কার্যকারিতা কমানোর প্রয়াস দীর্ঘদিনের হলেও গত কয়েক বছর অন্তত ২১ ফেব্রুয়ারি এবং পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে এই পরিষদের সভা ডাকা হয়েছিল। কিন্তু গত বছর থেকে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বের একমাত্র ও শেষ অবলম্বনটিরও বিনা কারণে এবং বিনা নোটিশে পরিবেশ মিটিং ডাকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন
ডাকসু সচল না থাকলেও প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা ফি দিতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব পরিচালকের তথ্যানুযায়ী, ডাকসু ও হল সংসদের ফি হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতি বছর ১২০ টাকা করে নেওয়া হয়। সে হিসাবে সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনের পর থেকে এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এক কোটি টাকার বেশি ফি আদায় করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এছাড়া ডাকসুর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ প্রতি বছর খরচ করা হচ্ছে কমবেশি ৩০ লাখ টাকা।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ‘সবখানে বলা হয় গণতান্ত্রিক পরিবেশ আছে। কিন্তু আমরা তো কোথাও তা দেখি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরোধীমতের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না, হলে থাকতে দেওয়া হয় না। শিক্ষার্থীদের কথা বলার একমাত্র জায়গা ছাত্র সংসদ। হল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদেও কোনো নির্বাচন নেই। নির্বাচন না থাকলে সেটা আবার গণতান্ত্রিক পরিবেশ হয় কীভাবে? ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হলে শিক্ষার্থীদের অধিকারের কথা কে বলবে? শিক্ষার্থীদের তো কোনো প্রতিনিধি নেই।’
গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিয়ে ক্ষোভ আছে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যেও। তাদের দাবি, একমাত্র ছাত্রলীগ ছাড়া বাকি সব সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক প্রকার উপেক্ষিত। ছাত্রলীগ সবকিছু দখল করে রেখেছে। তাদের মতের বাইরে কোনো শিক্ষার্থীই যেতে পারেন না। যেতে চাইলেই শিকার হতে হয় চরম নির্যাতনের।
আরও পড়ুন
পরিবেশ পরিষদের অকার্যকারিতা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকা নিয়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ঢাবি শাখার সভাপতি সাদেকুল ইসলাম সাদিক বলেন, ‘পরিবেশ পরিষদের মিটিং না ডাকার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরির যতটুকু সুযোগ থাকে তাও ধ্বংস করা হয়েছে। কেননা, ডাকসুর অনুপস্থিতিতে ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মধ্যে সহাবস্থান, শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখতে পরিবেশ পরিষদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছিল। এর মধ্যদিয়ে ক্যাম্পাসের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের যতটুকু সুযোগ ছিল, তাও বন্ধ করে দেওয়া হলো, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ধারণার পরিপন্থি।’
গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকার দাবি করেন ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহসও। তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস আদতে দেশব্যাপী গণতন্ত্রের শ্বাসরোধ করা বাকশালের একটি ক্ষুদ্র শাখায় পরিণত করা হয়েছে। ঢাকা শহরের ধুলাবালিযুক্ত বাতাস যেমন এখন মুখবন্ধনী (মাস্ক) ছাড়া মুক্তভাবে শ্বাস নেওয়ার অনুপযুক্ত, তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পরিবেশও এখন মুক্তভাবে মতপ্রকাশের অনুপযুক্ত।’
‘ছাত্রলীগের ত্রাস সৃষ্টিকারী কার্যক্রমের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে, এ অবস্থায় মুক্তমতের চর্চা করে এমন সব সংগঠনই আসলে অকার্যকর। এসবের থেকে মুক্তির জন্য দেশব্যাপী সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের দলমত নির্বিশেষে অংশগ্রহণের বিকল্প নেই।’
আরও পড়ুন
ডাকসু নির্বাচন না হওয়া ভালো চর্চা নয় স্বীকার করে শিগগির নির্বাচন চেয়েছেন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর সাবেক সদস্য তানভীর হাসান সৈকত। তবে ডাকসু নির্বাচন না থাকাকে পুরোপুরি গণতন্ত্রহীনতা বলতে নারাজ তিনি।
এই ছাত্রনেতা জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ মনে করে সবার আগে ডাকসু নির্বাচন হওয়া উচিত। ছাত্রলীগ বারবার সাবেক উপাচার্য (অধ্যাপক আখতারুজ্জামান) এবং বর্তমান উপাচার্যের (এ এস এম মাকসুদ কামাল) কাছে আহ্বান জানিয়েছে। যেখানে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার নির্বাচন হচ্ছে, সেখানে আমাদের নির্বাচন কেন হবে না? আমরা চাই, শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে যত দ্রুত সম্ভব ডাকসু নির্বাচন দেওয়া হোক।’
তিনি বলেন, ‘এটাকে সম্পূর্ণ গণতন্ত্রহীনতাও বলা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যেটাকে বলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সমান অধিকার, সেই জায়গাটা থেকে আমরা শিক্ষার্থীরা বরাবরই বঞ্চিত হয়ে আসছি। সেক্ষেত্রে আমরা বলবো ডাকসু নির্বাচন হলেও ডাকসুর সভাপতি পদটা কিন্তু উপাচার্যের। এটি কিন্তু হওয়া উচিত নয়। আমরা মনে করি ডাকসুর সভাপতি হবে ছাত্রদের প্রতিনিধি। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বডি থাকা মানেই এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা। সেক্ষেত্রে ডাকসুকেও পুরোপুরি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বলা যায় না।’
আরও পড়ুন
সর্বশেষ ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ও ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানী জাগো নিউজকে বলেন, ‘সর্বশেষ ডাকসুতে আমরা পূর্ণ দায়িত্ব পালন করার আগেই করোনা মহামারি চলে আসে। ফলে আমরা কিন্তু দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। ডাকসুর ব্যানারেই আমাদের কাজ করার সুযোগ ছিল। সেসময় উপাচার্যের অনাগ্রহ ও অসহযোগিতায় কিন্তু আমরা কাজটা করতে পারিনি।’
‘বর্তমান উপাচার্য অত্যন্ত আন্তরিক বলে আমরা জানি। আশা করি তিনি ডাকসুকে ক্যালেন্ডার ইয়ারে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য উদ্যোগ নেবেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলে এক সপ্তাহের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন করা সম্ভব। এটা না করার পুরো ব্যর্থতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের।’
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনুকূল পরিবেশ পেলে ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করার কথা জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে সর্বশেষ ডাকসুর ভিপি ও গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনুকূল পরিবেশ নেই কীভাবে? বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনো আন্দোলন এই মুহূর্তে চলছে না যে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক। আমরা তো সবকিছু স্বাভাবিকই দেখছি। মাত্র কয়েকদিন আগে একটি জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেলো। মূলত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চায় না এখান থেকে নেতৃত্ব বের হয়ে এসে ফ্যাসিবাদের পতনে ভূমিকা রাখুক। সেজন্য তারা সবকিছু স্বাভাবিক থাকা সত্ত্বেও অনুকূল পরিবেশ পাচ্ছে না।’
ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) সীতেশ চন্দ্র বাছার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সামনে হবে কি না সেটা তো এই মুহূর্তে বলা যায় না। সবার সঙ্গে আলোচনা করে তারপর বলতে হবে। তবে এটা হওয়া উচিত- এটুকু মনে করি। সময়মতো অবশ্যই জানানো হবে।’
হাসান আলী/ইএ/জেআইএম