যৌন নিপীড়নসহ নানা অভিযোগ
শেকৃবিতে তদন্ত কমিটি হয়, শেষ হয় না বিচার
- রামদা দেখিয়ে প্রাণনাশের হুমকিকে ‘কিছু হবে না’ বলে আশ্বস্ত করেই খালাস
- বছর পার হলেও মেলেনি যৌন নিপীড়নের বিচার
- ১৮ মাসেও আলোর মুখ দেখেনি শিক্ষক লাঞ্ছনার তদন্ত
গত দেড় বছরে শিক্ষক লাঞ্ছনা, যৌন নিপীড়ন, রামদা ঠেকিয়ে চাঁদাবাজিসহ নানান চাঞ্চল্যকর ঘটনার সাক্ষী হয়েছে রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি)। এসব ঘটনার প্রত্যেকটিতে গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। তবে অদৃশ্য কারণে এখনো ঝুলে রয়েছে বেশিরভাগ ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন। কিছুক্ষেত্রে প্রতিবেদন জমা দিলেও মেলেনি কাঙ্ক্ষিত বিচার। ফলে একদিকে যেমন বিচারহীনতায় রয়েছেন ভুক্তভোগীরা অন্যদিকে দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে অভিযুক্ত প্রভাবশালীদের।
২০২৩ সালের ১৬ নভেম্বর শেকৃবির কাজী নজরুল ইসলাম হলের ক্যান্টিন ম্যানেজার মো. জাহিদকে হলের ২২০ নম্বর কক্ষে ডেকে রামদা ঠেকিয়ে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন হল ছাত্রলীগ সভাপতি এস এম সজীব হোসাইন ও সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমান আরিফ। এসময় চাঁদার টাকা না পেলে হত্যার হুমকি দেয় উক্ত দুই নেতা। এমনকি তাকে হত্যা করলে ছয় মাসও জেল খাটতে হবে না বলে ভয় দেখান ম্যানেজারকে। ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন ক্যান্টিন ম্যানেজার। এরপর দীর্ঘদিন প্রাণনাশের ভয়ে ক্যান্টিন বন্ধ রাখলেও বিচার পাননি তিনি।
অন্যদিকে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না করেই ম্যানেজারকে আশ্বস্ত করা হয় ‘কোনো প্রকার সমস্যা হবে না’ বলে। ঘটনার চার মাস পার হলেও এখনো ঝুলে আছে তদন্ত প্রতিবেদন। এদিকে হুমকির পরেই নানাবিধ সমস্যার কারণে ক্যান্টিন ম্যানেজার জাহিদকে ছাড়তে হয়েছে দায়িত্ব। উল্লেখ্য এ দুই নেতার বিরুদ্ধে আগেও নানা অভিযোগ থাকায় ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন।
আরও পড়ুন
এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক অলোক কুমার বলেন, ‘আমরা কতগুলো বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করে তদন্ত করছি। অভিযোগগুলো পেয়েছি, তবে তদন্ত করে প্রমাণ বের করতে কিছুটা সময় লাগছে।’
শেকৃবিতে ২০২৩ সালের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীদের যৌন ও মানসিক নির্যাতনের। ২০২৩ সালের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ফাইন্যান্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবু জাফর আহমেদ মুকুল কর্তৃক ছাত্রীদের যৌন ও মানসিক নির্যাতনের তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়। তবে এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সহযোগী অধ্যাপক মুকুলের বিরদ্ধে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ছিল, গভীর রাতে ভিডিও কল, সকালে রুটিনমাফিক ফোন কল, একা কফি শপে ডাকা, অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে উত্ত্যক্ত করাসহ শিক্ষক বানানোর প্রলোভনে কাছে টানার চেষ্টা করতেন তিনি।
এছাড়াও ছাত্রীদের ব্যক্তিগত বিষয়ে হয়রানির প্রতিবাদ করলে তাদের পাগল ও অটিস্টিক বলে সম্বোধনের অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনার পূর্বেও ২০১৩ সালে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে একই রকমের অভিযোগ আসে। সেসময় তদন্ত কমিটি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। তবে সম্প্রতি আলোচিত এ ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলেও বিচার হয়নি অভিযুক্ত শিক্ষকের।
উক্ত তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধকল্পে গঠিত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক লাম ইয়া আসাদ, সদস্যসচিব এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক হারুন-উর-রশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বলেন, ‘আমরা আমাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। বিষয়টি সিন্ডিকেট মিটিংয়ে সম্ভবত পাস হয়েছে। শিগগির বিচারিক কার্যক্রম শুরু হবে বলে আশা করছি।’
আরও পড়ুন
এছাড়া ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে শেকৃবির কয়েকজন কর্মকর্তা কর্তৃক শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি ও প্যারাসাইটোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. এম এ মান্নানের সঙ্গে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর সহকারী অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর অভিযোগ করলে অধ্যাপক ড. মোহাম্মেদ আলীকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তবে ঘটনার ১৮ মাস পরও আলোর মুখ দেখেনি শিক্ষক লাঞ্ছনার তদন্ত প্রতিবেদন।
তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার শেখ রেজাউল করিম বলেন, ‘আমাদের তদন্ত প্রায় শেষের দিকে। খুব শিগগির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সার্বিক তদন্তের ধীর গতির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক অলোক কুমার পাল বলেন, ‘তদন্ত ধীরগতিতে হচ্ছে এমনটা বলা যায় না। আমরা যথাযথ দ্রুত করার চেষ্টা করছি। এর মধ্যে যৌন নিপীড়ন তদন্তের অগ্রগতি বেশ ভালো। অভিযোগগুলোর তদন্ত ও প্রমাণ করে ডকুমেন্ট তৈরি করে শাস্তির আওতায় আনা অনেক জটিল কাজ।’
তাসনিম আহমেদ তানিম/ইএ/এমএস