সংসার চালাতে হিমশিম
চাকরি সরকারিকরণের আশায় হলেই জীবন কাটিয়ে দিলেন শ্রী রাজেশ
আবাসিক হলের ওয়াশরুম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে খুব সকালেই উঠতে হয় তাকে। সকাল ৯টা থেকে শুরু করেন শিক্ষার্থীদের সারাদিনের ফেলা উচ্ছিষ্ট আবর্জনা ও ড্রেন পরিষ্কারের কাজ। একে একে প্রতিটি ব্লকের প্রতিটি তলায় ঝাড়ু দিতে হয় তাকে। এরপর শুরু করেন শিক্ষার্থীদের ওয়াশরুম পরিষ্কারের কাজ। প্রায় ৫০টিরও অধিক ওয়াশরুম পরিষ্কার করতে ঘড়ির কাটায় বেজে যায় দুপুর ১টা। কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে আবার শুরু করেন হলের মূল ফটকের সামনের রাস্তা পরিষ্কারের কাজ।
এভাবেই বিরামহীনভাবে ১৮ বছর যাবত কাজ করে চলেছেন তিনি। শুরুতে বেতন ছিল ১ হাজার টাকা। আঠারো বছর পর এখন বেতন পান মাত্র ৫ হাজার টাকা। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতিতে এতো অল্প বেতন দিয়ে সংসার চালাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। তবুও শিক্ষার্থীদেরকে ভালোবেসে অল্প বেতন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে দিন গুনছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শহীদ জিয়াউর রহমান হলের পরিচ্ছন্ন কর্মী (সুইপার) শ্রী রাজেশ দাস।
শহীদ জিয়াউর রহমান হলে শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিত একটি নাম শ্রী রাজেশ দাস। শিক্ষার্থীদের দেখলেই হাসি দিয়ে দাদা বলে ডাক দিতে ভোলেন না তিনি। তার এমন সরলতার কারণে হলের কর্মকর্তারাও তাকে খুব স্নেহ করেন।
রাজশাহীর লক্ষ্মীপুরের আইডি বাগানপাড়া, রামকৃষ্ণ পল্লীতে ভাড়া থাকেন রাজেশ। নিজস্ব জায়গা বলতে কিছুই নেই তার। তার বয়স এখন প্রায় পঞ্চাশের কোঠায়। প্রায় ১৮ বছর ধরে তিনি শহীদ জিয়াউর রহমান হলে পরিচ্ছন্ন কর্মীর (সুইপার) কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তার এক ছেলে ও দুই মেয়ে। বর্তমানে একার পক্ষে এতো অল্প বেতন দিয়ে সংসার চালাতে না পারায় তার স্ত্রীও সুইপারের কাজ করেন।
শ্রী রাজেশ দাস ২০০৫ সালে এক হাজার টাকার বিনিময়ে অস্থায়ী সুইপারের কাজ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জিয়াউর রহমান আবাসিক হলে। পরে ধাপে ধাপে তার টাকা বেড়ে ১৫০০, ২ হাজার, ৩ হাজার ও সর্বশেষ ৫ হাজার টাকা বেতন হয়। এই ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে সাত ঘণ্টা কাজ করতে হয় তাকে। তার চাকরি সরকারিকরণ হবে এমন আশায় ১৮ বছর ধরে প্রহর গুনছেন তিনি।
রাজেশের এক মেয়ে রাজশাহীর লক্ষ্মীপুর বহুমুখী বিদ্যালয়ে ক্লাস নাইনে পড়ছে। কিন্তু ঠিকঠাকভাবে বেতন দিতে পারেন না তিনি। তার ইচ্ছা মেয়েকে পড়াশোনা করাবেন। ছেলেটাকে কিছুটা পড়িয়ে আর পড়াতে পারেননি রাজেশ। আগে হলের কাজের পাশাপাশি পরিবারের কথা চিন্তা করে অতিরিক্ত কাজ করতেন রাজেশ। কিন্তু বয়সের ভারে এখন আর অন্য কোনো কাজ করতে পারেন না। ফলে বর্তমান দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতিতে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাকে।
শ্রী রাজেশ দাস জাগো নিউজকে বলেন, আমি সাত ঘণ্টা কাজ করে মাত্র ৫ হাজার টাকা বেতন পাই। মাঝে মাঝে না খেয়েও আমাকে কাজে আসতে হয়। বর্তমানে বাজারের যে অবস্থা সেখানে আমার ৫ হাজার টাকা কিছুই না। এতো অল্প টাকা দিয়ে আমার সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাচ্চাদেরকেও ভালোভাবে পড়াশোনা করাতে পারছি না। তাদের ভবিষ্যত নিয়ে খুবই চিন্তিত আমি। বয়সের ভারে আগের মতো এখন অতিরিক্ত কাজও করতে পারি না। অভাবের সংসার হওয়ায় আমার স্ত্রীও সুইপারের কাজ করে থাকে।
তিনি বলেন, আমার পুরো জীবনটাই আমি শহীদ জিয়াউর রহমান হলে শিক্ষার্থীদের সেবায় কাটিয়েছি। এখন আর আমি চলতে পারছি না। ১৮ বছর যাবত কাজ করছি শুধু এ চাকরিটা সরকারিকরণ হবে সেই আশায়। কিন্তু আমাকে শুধু আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ, ১৮ বছরেও কোনো কিছুই হয়নি আমার।
প্রশাসনের উদ্দেশ্যে রাজেশ দাস বলেন, প্রশাসনের কাছে এখন আমার একটাই চাওয়া, আমার চাকরিটা মাস্টাররোল করে দেওয়া হোক। যদি সেটা না হয়, তাহলে আমাকে দিনমজুর হিসেব টাকা দেওয়া হোক। দিন মুজুর হিসেবে টাকা পেলেও আমি আমার সংসার চালাতে কিছুটা সক্ষম হবো। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
শহীদ জিয়াউর রহমান হলের প্রভোস্ট ড. সুজন সেন বলেন, শ্রী রাজেশ দাস একজন ভদ্রলোক। তিনি তার কাজের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল। তার বিষয়ে আমি এখনো পর্যন্ত কোনো অভিযোগ পাইনি। তবে তার বেতনের বিষয়ে আমি শুনেছি। বর্তমান সময়ে এতো অল্প বেতন দিয়ে কিছুই হয় না। আমি হলে দায়িত্ব পাওয়ার আগে তার বেতন আরও কম ছিল। হলের ছাত্র তহবিল থেকে তার বেতন দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হাতে। তবে নিয়োগ যখন চালু হবে, তার চাকরির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আমি সুপারিশ করবো।
এফএ/জেআইএম