ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
কারাগারে সাড়ে ১১ মাস, অনিশ্চিত শিক্ষাজীবন খাদিজার
★ ১৭ বছর বয়সে প্রাপ্তবয়স্ক দেখিয়ে মামলা, ১১ মাস ধরে কারাগারে
★ পরিবারের দাবি, খাদিজার শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে
★ কারাগারে কাঁথা সেলাই করছেন খাদিজা
★ খাদিজার শিক্ষাজীবন নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা
★ খাদিজার মুক্তি দাবি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহের
★ আগামী ৩০ নভেম্বর চার্জ গঠনের শুনানি
‘খাদিজার কিডনিতে পাথর ধরা পড়েছে, ঠিকভাবে তার চিকিৎসা করা হয়নি। মেডিকেল রিপোর্টে জানানো হয়, তার শরীরে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু কারাগারে খাদিজার সঙ্গে দেখা হলে সে বলে, তার শরীর একদমই ভালো থাকে না। কারাগারে তাকে পড়ালেখার সুযোগও দেওয়া হচ্ছে না। ও মানসিকভাবে একদম ভেঙে পড়েছে।’ কথাগুলো বলেছিলেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী খাদিজাতুল কুবরার বড় বোন সিরাজুম মনিরা।
গত বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) জাগো নিউজকে মুঠোফোনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং অ্যাকাডেমিক নথি অনুসারে ২০২০ সালে যখন খাদিজার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়, তখন তার বয়স ছিল ১৭ বছর। অথচ তাকে প্রাপ্তবয়স্ক দেখিয়ে মামলা দুটি করা হয়েছিল। এরমধ্যে একটি মামলায় খাদিজার বয়স ১৯ এবং অন্যটিতে ২২ বছর দেখানো হয়।
আরও পড়ুন: ইউটিউব, ফেসবুক লাইভে বক্তব্যের দায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিতে হবে
কারাগারে থেকে খাদিজা পড়াশোনা করতে পারছেন কি না- জানতে চাইলে সিরাজুম মনিরা বলেন, সবকিছু ঠিক থাকলে খাদিজা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারের (২০১৯-২০) ছাত্রী থাকতো। কারাগারে সে পড়তে পারছে না। কারাগারে থাকা অবস্থায় তার একটি সেমিস্টার চলে গেছে, দ্বিতীয় সেমিস্টারও শেষ হওয়ার পথে। পড়াশোনা ও পরীক্ষা চালিয়ে যেতে তাকে আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে। তারপর সব ডকুমেন্টস দিয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে পড়াশোনা করার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারবে। কয়েকদিনের মধ্যে এ বিষয়ে আবেদন করা হবে।
খাদিজা কি জানতেন, তিনি যে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে যাচ্ছে, সেখানে কী ধরনের কথা হতে পারে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অনুষ্ঠানে সঞ্চালকের প্রশ্নগুলো পূর্ব নির্ধারিত ছিল। সেসব প্রশ্ন সম্পর্কে খাদিজা কিছুই জানতো না। সে নিজে থেকে কোনো প্রশ্ন করেনি। মেজর দেলোয়ারকেও সে চিনতো না৷
তিনি বলেন, কারাগারে কাজ করে থাকতে হয়, সে কারণে খাদিজা রাইটারের কাজ বেছে নিয়েছিল। তাকে কনডেম সেলে রাখা হয়েছিল। পরে তাকে দিয়ে মাটি কাটানো হয়েছে, ঘাস কাটানো হয়েছে। বর্তমানে কারাগারে সে কাঁথা সেলাইয়ের কাজ করে। সম্ভবত ১৭-১৮ দিনের মধ্যে তাকে একটা কাঁথা সেলাই করতে হয়। জামিন স্থগিত হওয়ায় মামলায় এখন বিকল্প কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ নেই।
কে এই খাদিজা?
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী খাদিজা। পরিবারের দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। তার বাবা কুয়েত প্রবাসী।
আরও পড়ুন: খাদিজার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন ৩০ নভেম্বর
আদালত ও আইনজীবী সূত্রে জানা যায়, অনলাইনে সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রচারসহ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগে ২০২০ সালের অক্টোবরে খাদিজা ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পৃথক দুটি মামলা করে পুলিশ। একটি রাজধানীর কলাবাগান থানায়, অন্যটি নিউমার্কেট থানায়। ওই দুই মামলায় গত বছরের ২৮ আগস্ট খাদিজাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
এরপর সাইবার ট্রাইব্যুনালে কয়েকবার জামিন চেয়েও না পাওয়ায় উচ্চ আদালতে আপিল করেন খাদিজার আইনজীবী। উচ্চ আদালত ২০২২ সালের ৬ নভেম্বর দুই মামলায় আপিল আবেদন গ্রহণ করেন।
এরপর গত ১৬ ফেব্রুয়ারি আপিল মঞ্জুর করে খাদিজাকে জামিন দেন হাইকোর্ট। তবে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে হাইকোর্টের জামিন আদেশ স্থগিত হয়। আপিল বিভাগে খাদিজার জামিন বিষয়ে সবশেষ শুনানি হয় গত ১০ জুলাই। আপিল বিভাগ তার জামিন প্রশ্নে শুনানি আরও চার মাস মুলতবি রেখেছেন।
গত ১১ জুলাই খাদিজার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন শুনানির দিন ধার্য ছিল। কিন্তু বিবাদীপক্ষের সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাইবার ট্রাইবুনাল তা মঞ্জুর করে চার্জ শুনানির জন্য আগামী ৩০ নভেম্বর দিন ধার্য করেন।
মামলা সূত্রে জানা যায়, খাদিজার বিরুদ্ধে দুটি মামলা মধ্যে নিউমার্কেট থানার মামলার বাদী পুলিশের উপ-পরিদর্শক খাইরুল ইসলাম আর কলাবাগান থানার মামলার বাদী উপ-পরিদর্শক আরিফ হোসেন। দুজন বাদীই দায়িত্ব পালনকালে মোবাইল ফোনে ইউটিউবে ঘুরতে ঘুরতে খাদিজাতুল কুবরা ও মেজর (অব.) দেলোয়ার হোসেনের ভিডিও দেখতে পান। ২০২০ সালের ১১ ও ১৯ অক্টোবর তারা দুজন নিজ থানায় বাদী হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দুটি দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত করে ২০২২ সালের ১৬ মে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মাজহারুল ইসলাম। আদালত চার্জশিট গ্রহণ করে আসামিরা পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
আরও পড়ুন: খাদিজার জামিন বিষয়ে শুনানি মুলতবি
এরপর ২০২২ সালের ২৭ আগস্ট খাজিদাকে গ্রেফতার করা হয়। অনুষ্ঠান সঞ্চালক খাজিদা গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকলেও অবসরপ্রাপ্ত মেজর দেলোয়ার এখনো পলাতক। আর মাত্র দুই সপ্তাহ পর খাদিজার কারাবাসের এক বছর পূর্ণ হবে। তিনি বর্তমানে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে বন্দি।
খাদিজার অপরাধ ছিল একটি ফেসবুক ওয়েবিনার হোস্ট করা, যেখানে অতিথি বক্তা হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত মেজর দেলোয়ার বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন। ২০২০ সালে করা দুটি মামলার একটিতে খাদিজার বয়স ১৯ এবং অন্যটিতে ২২ বছর দেখানো হয়।
উভয় মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, খাদিজা বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ঘোলা করার চেষ্টা করছেন, সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে সাধারণ জনগণকে জড়িত করছেন এবং বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছেন।
সেখানে আরও বলা হয়, অভিযুক্তরা বাংলাদেশের বৈধ সরকারের পতনের চেষ্টা করছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী, সরকারি সংস্থা ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অপমান করেছেন।
ওয়েবিনারের যে ভিডিওর ভিত্তিতে মামলা করা হয়েছে সেখানে সঞ্চালক হিসেবে খাদিজা অতিথি বক্তাকে প্রশ্ন করেছেন, আইনশৃঙ্খলার বর্তমান অবনতি ও সামাজিক অবক্ষয় সম্পর্কে আপনার মতামত কী? ছাত্র রাজনীতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ? আপনি কি মনে করেন বিএনপি বিরোধী দল হিসেবে তার ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে?
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক ল্যাবরেটরি রিপোর্ট অনুযায়ী, অতিথি বক্তা দেলোয়ারের বক্তব্য থেকেই প্রশ্নগুলো করছিলেন খাদিজা। তবে সিআইডি যে প্রতিক্রিয়াগুলোকে ‘বিদ্বেষমূলক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে রয়েছে সরকারকে ‘ফ্যাসিবাদী’ বলা। ওই অনুষ্ঠানের আলোচনায় দাবি করা হয়, একটি দেশপ্রেমিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য গণঅভ্যুত্থান প্রয়োজন।
কারাগারে খাদিজার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে পরিবার:
খাদিজার বড় বোন সিরাজুম মনিরা বলেছেন, কারাগারে খাদিজার পেছনে প্রতি মাসে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা দেওয়া লাগে। আমরা মাসে দুবার তার সঙ্গে দেখা করি। এ পর্যন্ত অনেক টাকা খরচ হয়েছে।
খাদিজার মুক্তির দাবিতে সোচ্চার সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো:
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে থাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজার মুক্তির দাবি জানিয়েছে প্রতিবাদী বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। একই সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলেরও দাবি করা হয়। গত কোরবানির ঈদের আগেও খাদিজাসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতারদের মুক্তির দাবিতে ভিক্টোরিয়া পার্কে মানববন্ধন করে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সংগঠন।
খাদিজা ছাড়া পরিবারের ঈদ:
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুই মামলায় গ্রেফতার হয়ে ১১ মাসের বেশি সময় কারাগারে পার করেছেন খাদিজাতুল কুবরা। এ কারণে গত ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় তিনি পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারেননি। এ নিয়ে খাদিজার মা ফাতেমা খাতুনের আক্ষেপের কথা জানান মুনিরা।
বিয়ের আসরে বর-কনের খাদিজার মুক্তি দাবি:
গত ২৫ এপ্রিল ঝিনাইদহে বিয়ের আসর থেকে খাদিজার মুক্তির দাবি জানান বর ছাত্র ইউনিয়ন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের দপ্তর সম্পাদক মাহমুদুল হাসান হৃদয় ও কনে সুমাইয়া আফরিন। বিয়ের আসরে নবদম্পতির হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল- ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করো’ এবং ‘খাদিজার মুক্তি দাও’।
জবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান মেজবাহ-উল-আলম সওদাগর জাগো নিউজকে বলেন, কারাগারে থাকায় গত প্রায় এক বছর ধরে খাদিজা ক্লাসে অনুপস্থিত। সে খুব মেধাবী শিক্ষার্থী ছিল। ওর কারাবাস খুবই দুঃখজনক। ও ছোট মানুষ। এতকিছু হবে তা হয়তো বুঝতে পারেনি।
খাজিদার ছাত্রত্ব থাকবে কি না- এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের কীইবা করার আছে। আমরা কী করতে পারি। আমরা তো আইনের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবো না। আমি খুব করে চাই, দ্রুত ওর জামিন হোক, ও ক্লাসে ফিরুক।
জবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক জানিয়েছেন, কোনো শিক্ষার্থী একটানা দুই বছর ক্লাস না করলে এবং পরীক্ষায় অংশ না নিলে তার ছাত্রত্ব বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। খাদিজাতুল কুবরা অনেক দিন ধরে কারাগারে। ক্লাস কিংবা পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছেন না।
এমকেআর/জিকেএস