নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়
প্রক্টর-ডিন-বিভাগীয় প্রধানও তিনি
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাককানইবি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. উজ্জ্বল কুমার প্রধান। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের টানা তিনবারের প্রক্টর তিনি।
পাশাপাশি দায়িত্ব পেয়েছেন বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও একটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবেও। এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব একাই সামলাচ্ছেন তিনি।
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন লঙ্ঘন ও ইউজিসির নির্দেশনা অমান্য’ করে তাকে তিনটি দায়িত্ব দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভ জানাচ্ছেন একাধিক শিক্ষক।
একই ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ এই তিন দায়িত্বে থাকা নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনা, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৬ এর লঙ্ঘনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ আলোচনায় এসেছে।
২০০৬ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনের প্রথম সংবিধির দফা-১৭ (২) তে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব দায়িত্বের জন্য আর্থিক সুবিধা দেওয়া হবে সেসব দায়িত্বের মধ্যে একসঙ্গে একাধিক দায়িত্ব কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে দেওয়া যাবে না।
অভিযোগ উঠেছে, আইনের সংবিধিতে সুস্পষ্টভাবে এটি বলা থাকলেও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এমন নিয়োগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এছাড়া প্রক্টরের বর্তমান দায়িত্ব ও ডিন হিসেবে নিয়োগেও রয়েছে নানা বিতর্ক। জানা যায়, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬১তম সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্তক্রমে প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পান ড. উজ্জ্বল। সে বছরের ১৮ জুলাই তারিখ থেকে এ দায়িত্ব কার্যকর করা হয়। নির্ধারিত দুই বছর মেয়াদ শেষে তিনি ২০২০ সালে দ্বিতীয়বারের মতো এই দায়িত্ব নেন।
২০২২ সালে সে দায়িত্বের মেয়াদ শেষ হলে তাকে নতুন করে প্রক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে এবার নির্দিষ্ট কোনো মেয়াদ নেই। এবারে তার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ‘পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত’ শব্দগুলো উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে নির্দিষ্ট মেয়াদের পরিবর্তে এ ধরনের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিয়োগদানে ইউজিসির নির্দেশনাকে অমান্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষক অভিযোগ করেন, এই নিয়োগে ইউজিসির নির্দেশনাকে সম্পূর্ণরূপে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
গত বছরের ২০ মার্চ ইউজিসি থেকে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১০ বছরের অধিক বয়সের বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে চুক্তিভিত্তিক, অতিরিক্ত দায়িত্ব বা চলতি দায়িত্বের পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন/প্রবিধান অনুযায়ী, স্থায়ী নিয়োগের অনুরোধ করা হচ্ছে। এই নির্দেশনাকে উপেক্ষা করেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ড. উজ্জ্বল কুমার প্রধানকে দায়িত্ব দিয়েছে।
এদিকে, গত ১৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৯তম সিন্ডিকেট সভার অনুমোদনক্রমে বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের ডিন হিসেবে নিয়োগ পান ড. উজ্জ্বল। ডিন নিয়োগেও রয়েছে জ্যেষ্ঠতার ক্রম না মানার অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৬ এর ২২(৫) ধারায় বলা হয়েছে, ভাইস চ্যান্সেলর সিন্ডিকেটের অনুমোদনক্রমে, প্রত্যেক অনুষদের জন্য অনুষদভুক্ত বিভিন্ন বিভাগের অধ্যাপকদের মধ্যে থেকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে, পালাক্রমে দুই বছর মেয়াদের জন্য ডিন নিয়োগ করবেন। কিন্তু এই অনুষদে জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে সপ্তম অবস্থানে ছিলেন অধ্যাপক উজ্জ্বল। এখানেও আইনের সম্পূর্ণ ব্যত্যয় ঘটেছে।
এরপর এবছরের ১ জানুয়ারি এই অনুষদের অধীন এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (ইএসই) বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দেন তিনি। একাডেমিক ও প্রশাসনিক এই তিনটি দায়িত্বের পাশাপাশি ড. উজ্জ্বল শিক্ষক নেতাও। তিনি আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন বঙ্গবন্ধু-নীলদলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
একইসঙ্গে তিনটি দায়িত্ব পালন করা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. শেখ সুজন আলী বলেন, একজন ব্যক্তিকে একইসঙ্গে একাধিক দায়িত্ব না দিয়ে দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে বণ্টন করা হলে তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজের গতিশীলতা বাড়বে বলে আমি মনে করি।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. তুহিনুর রহমান (তুহিন অবন্ত) বলেন, যে পরিস্থিতিতে তাকে এই দায়িত্বগুলো দেওয়া হয়েছে তাতে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে বলে আমার তা মনে হয় না।
ডিন নিয়োগে জ্যেষ্ঠতার ক্রম অনুসরণ না করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো যৌক্তিক কারণ থাকলে জ্যেষ্ঠতার ক্রম অনুসরণ না করা হতেই পারে। এটা আমি খুব বেশি অসামঞ্জস্য মনে করি না।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু নীলদলের সাধারণ সম্পাদক ড. সেলিম আল মামুন এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অন্য এক শিক্ষক নেতা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে যেখানে স্পষ্ট বলা আছে যে আর্থিক সুবিধা আছে এমন দায়িত্বে একজন ব্যক্তিকে একাধিক দায়িত্ব দেওয়া যাবে না, সেখানে তিন তিনটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কী করে তাকে দেওয়া হয়। বিষয়টি আশ্চর্যজনক ও অদ্ভুত।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. উজ্জ্বল কুমার প্রধান বলেন, উপাচার্য বিধির মধ্যে থেকেই আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। এখানে কোনো বিধির লঙ্ঘন হয়েছে বলে আমি মনে করি না।
ডিন নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তক্রমে আমাকে ডিন হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।
এ বিষয়ে জাককানইবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, এখানে সিন্ডিকেট যা ভালো মনে করেছে তাই হয়েছে। এখানে ভিসি এককভাবে কিছু করেন না। ভিসি যা করেন তা হলো সিন্ডিকেটে বিষয়গুলো উপস্থাপন করা। সিন্ডিকেট চাইলে অনেক কিছু বাতিলও করতে পারে।
এমআরআর/এমএস