অছাত্র-চাঁদাবাজরা হতে চান রাবি ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদক!

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৫৩ পিএম, ০৮ নভেম্বর ২০২২
আসাদুল্লাহ হিল গালিব, মুশফিক তাহমিদ তন্ময় ও মেহেদী হাসান মিশু/ছবি: সংগৃহীত

আসাদুল্লাহ হিল গালিব। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ভর্তি হন। ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে টানা তিন বছরেও প্রথমবর্ষ শেষ করতে পারেননি তিনি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী- তার ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যায়। ছাত্রত্ব খোয়ানো সেই গালিব এখন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আসন্ন সম্মেলনে পদ পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। দেশের অন্যতম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের শীর্ষ পদ পেতে এসএসসি ও এইচএসসি পাসের তথ্য দিয়েছেন নিজের জীবনবৃত্তান্তে। অথচ ক্যাম্পাসে জোর গুঞ্জন- সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদের যেকোনো একটিতে আসতে পারেন এইচএসসি পাস প্রার্থী গালিব।

শুধু গালিব নয়, রাবি ছাত্রলীগের আসন্ন সম্মেলনে পদ পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন অছাত্র, চাঁদাবাজ, সিটবাণিজ্য, মাদক কারবারি ও ভর্তিবাণিজ্যে জড়িতরা। সম্মেলনে পদ পেতে যে ৯৩ জন প্রার্থী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়েছেন, তাদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে অপকর্মের দীর্ঘ তালিকা।

ছাত্রলীগের দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ৯৩ জন জীবনবৃত্তান্ত জমা দিলেও শীর্ষ দুই পদের দৌড়ে আলোচনায় রয়েছেন এক ডজন নেতা। তাদের মধ্যে অছাত্র, চাঁদাবাজ, মাদক কারবারি ও ভর্তিবাণিজ্যে জড়িতরাও রয়েছে। অথচ ছয় বছর পর ১২ নভেম্বরের সম্মেলনে রাবি ছাত্রলীগে সৎ, যোগ্য, ক্লিন ইমেজধারী ও ছাত্রত্ব আছে- এমন নেতাদের নেতৃত্বে চাইছেন কর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ধারার শিক্ষকদেরও চাওয়াও একই।

আরও পড়ুন: ‘লোকাল’ নেতৃত্ব থেকে এবার কি বেরোতে পারবে রাবি ছাত্রলীগ?

জানা গেছে, গত ২৩ অক্টোবর সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে রাবি শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটির জন্য জীবনবৃত্তান্ত আহ্বান করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সপ্তাহ না যেতেই আরেকটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আগামী ১২ নভেম্বর রাবি ছাত্রলীগের সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় কমিটি। ৫ নভেম্বর পর্যন্ত পদপ্রত্যাশী নেতাকর্মীদের জীবনবৃত্তান্ত জমা নেওয়া হয়। এতে ৯৩ জন প্রার্থী সিভি জমা দেন।

নেতৃত্বের দৌড়ে বিতর্কিতরা
সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় আছেন মেহেদী হাসান মিশু। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত রাবি ছাত্রলীগের ২৫তম সম্মেলনে সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান তিনি। দায়িত্ব পাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে সিটবাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনুর অনুসারী বিভিন্ন হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে হলে হলে শিক্ষার্থী ওঠান তিনি।

২০১৯ সালের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের শের-ই-বাংলা হলে এক শিক্ষার্থীকে জিম্মি করে চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এসব ঘটনায় গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিতও হয়। এতে চরম বিতর্কের মুখে পড়েন মিশু। আসন্ন সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদে জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়েছেন তিনি। জীবনবৃত্তান্তে উল্লেখ করা তথ্যানুযায়ী- মেহেদী হাসান মিশু বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থী।

বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী—একজন শিক্ষার্থীকে সর্বোচ্চ ছয় শিক্ষাবর্ষের মধ্যে স্নাতক (সম্মান) শেষ করতে হয়। সেই হিসাবে ২০২২ সালে তার ভর্তি হওয়ার আট বছর পেরিয়ে গেছে। অর্থাৎ তার সম্মান শেষ করার সময়সীমা শেষ।

মেহেদী হাসান মিশু যে বিভাগের শিক্ষার্থী, সেই সমাজবিজ্ঞান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের নিয়মানুযায়ী নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে স্নাতক শেষ করতে না পারায় বিভাগ থেকে ড্রপ আউট (ছাত্রত্ব শেষ) হয়েছেন তিনি। সেই হিসেবে তার সর্বশেষ শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক, অর্থাৎ এইচএসসি পাস।

আরও পড়ুন: সভাপতি-সম্পাদক পদে ৯৫ পদপ্রত্যাশীর জীবনবৃত্তান্ত জমা

ছাত্রলীগ নেতা মেহেদী মিশুর বিষয়ে জানতে চাইলে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক বিজয় কৃষ্ণ বণিক বলেন, ‘আমরা তাকে (মিশু) বিভাগ থেকে প্রত্যয়নপত্র দিতে পারিনি। যদি তার ছাত্রত্ব থাকতো, তাহলে প্রত্যয়নপত্র দিতে তো কোনো সমস্যা ছিল না। এখন বাকিটা আপনারাই বুঝে নেন।’

ড্রপ আউটের বিষয়ে জানতে চাইলে মেহেদী হাসান মিশু বলেন, ‘আমার ছাত্রত্ব নেই বিষয়টি সঠিক নয়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে একটু রেজাল্ট খারাপ করি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী- কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে ছাত্রত্ব বজায় রাখার নিয়ম আছে। আমি বিভাগে এ বিষয়ে আবেদনও করেছি। বিষয়টি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ এবং রাজশাহীর অভিভাবকরা অবগত আছেন।’

আসন্ন সম্মেলনে সভাপতি পদের দৌড়ে বেশ আলোচনায় আছেন বিতর্কিত ছাত্রলীগ নেতা মুশফিক তাহমিদ তন্ময়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। ২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইয়াবাসহ অবৈধ মাদক সরবরাহে জড়িতদের তালিকায় তার নাম উঠে আসে।

চলতি শিক্ষাবর্ষে রাবির ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির ঘটনায়ও তার নাম আসে। এর প্রেক্ষিতে রাবি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে তাকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সম্প্রতি সম্মেলন সামনে রেখে সিভি জমা দেওয়ার তারিখ শেষ হওয়ার একদিন আগে মুশফিক তাহমিদ তন্ময়ের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। ফলে তিনি রাবি ছাত্রলীগের সভাপতি পদের জন্য সিভি জমা দিতে সক্ষম হন।

আরও পড়ুন: সম্মেলন সামনে রাবি ছাত্রলীগের ৩ নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার

ক্যাম্পাসে গুঞ্জন ছড়িয়েছে, মুশফিক তাহমিদ তন্ময় স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার পারিবারিক আত্মীয়ের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেছেন। পরবর্তীতে তার মাধ্যমে লবিং করে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করিয়েছেন তিনি। সেই ব্যক্তির মাধ্যমে রাবি ছাত্রলীগের শীর্ষ পদ পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন বিতর্কিত এ ছাত্রলীগ নেতা।

অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা মুশফিক তাহমিদ তন্ময়কে এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।

ছাত্রত্ব খুঁইয়ে পদ পেতে লবিং করা আসাদুল্লাহ হিল গালিবের দাবি তার ছাত্রত্ব আছে। কীভাবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে গালিব দাবি করেন তিনি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সান্ধ্যকালীন মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।

তার ভাষ্য, ‘ছাত্রত্ব বজায় রাখতে আমার যা করার সব করেছি। আমার সিভিতেও শিক্ষাগত যোগ্যতা দেওয়া আছে। প্রয়োজনে আপনারা বিভাগের শিক্ষকদের কাছে খোঁজ নিতে পারেন।’

আরও পড়ুন: রাবি ছাত্রলীগ নেতা তন্ময়ের নির্দেশে প্রক্সি দেন বায়জিদ

তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের স্নাতক (সম্মান) ড্রপ আউট হওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যান রাবি ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক আসাদুল্লাহ হিল গালিব।

মাদককাণ্ডে নাম ওঠা প্রসঙ্গে গালিব বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আগামী সম্মেলনে পদপ্রত্যাশীদের সবার ডোপ টেস্ট করানো হোক। তাহলেই তো বোঝা যাবে…।’

নেতৃত্বের দৌড়ে আলোচনায় আরও যারা
সম্মেলনে সভাপতি পদের দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি কাজী আমিনুল হক লিংকন। তিনি মার্কেটিং বিভাগ থেকে অনেক আগেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। তার বাড়ি বিশ্ববিদ্যালয় পার্শ্ববর্তী বুধপাড়া এলাকায়। একই এলাকার বাসিন্দা শাহিনুল সরকার ডন। তিনিও সভাপতি প্রার্থী। শাহিনুল সরকার ডনও বেশ আগেই পড়াশোনা শেষ করেছেন।

আরও পড়ুন: রাবিতে প্রক্সিকাণ্ডের মূলহোতা তন্ময়কে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার

সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় রয়েছেন মেজবাহুল হক, এনায়েত রাজু, জাকিরুল ইসলাম জ্যাক, সাজ্জাদ। এছাড়া সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদকের যেকোনো একটি পদ পেতে লবিং করছেন ফয়েজ উদ্দিন।

বিতর্কিতদের নিয়ে যা বলছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ
বিতর্কিত প্রার্থীদের পদে পেতে দৌড়ঝাঁপ করার বিষয়ে জানতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তারা কেউ কল রিসিভ করেননি।

পরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক মেহেদী হাসান তাপসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি রাবি ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতার দায়িত্বেও রয়েছেন।

মেহেদী হাসান তাপস বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট। এখানে ত্যাগী ও ক্লিন ইমেজধারী নেতাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। যেসব সিভি জমা পড়েছে, তা আমরা যাচাই-বাছাই করছি। বিতর্কিত, অছাত্র ও ড্রপ আউটরা কোনোভাবেই নেতৃত্বে আসতে পারবেন না।’

এএএইচ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।