ইতিহাস সংরক্ষণে ব্যতিক্রমী সংগ্রহশালা ‘হেরিটেজ আর্কাইভস’

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: ০৬:০৭ পিএম, ০৮ আগস্ট ২০২২

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) সংলগ্ন কাজলা এলাকার জামরুল তলায় অবস্থিত ‘হেরিটেজ আর্কাইভস’ যেন ইতিহাসের এক জীবন্ত সংগ্রহশালা। বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যের উপকরণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে রাবির ইতিহাস বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মাহবুবর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন এই আর্কাইভটি। ১৮৭২ সালে করা প্রথম আদমশুমারির রিপোর্ট, ভূমি জরিপের রিপোর্ট, সরকারি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেখা দুষ্প্রাপ্য প্রতিবেদন, লিফলেট, পোস্টার, স্মরণিকা, ফেস্টুন, ব্যঙ্গচিত্রসহ গত ৫০ বছরের মূল্যবান সব জিনিস এই সংগ্রহশালায় চোখে পড়বে।

এখানে এরই মধ্যে সংগৃহীত হয়েছে ৩ হাজার ৯৫ শিরোনামে প্রায় ৩০ হাজার সাময়িক পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন ও গবেষণা জার্নাল। রয়েছে প্রায় ৫ হাজার ২০০ পোস্টার ও পাঁচ হাজার লিফলেট। সংগ্রহশালায় রয়েছে দেশের ৬৪ জেলার ওপর প্রায় ১০ হাজার গ্রন্থ, স্মরণিকা ও বার্ষিকী। রয়েছে ৪৭১টি এমফিল-পিএইচডি থিসিস এবং ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

বিজ্ঞাপন

raj01

প্রায় ৩ হাজার ২০০টি জীবনী গ্রন্থ রয়েছে যার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ওপর লেখা জীবনী গ্রন্থ রয়েছে ৫৭২টি। রয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ গ্রন্থ, প্রায় ৫০০ রাজনৈতিক সাহিত্য। তাছাড়া বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম, শ্রমিক, নারী, রাজনৈতিক দল, ছাত্রসংগঠন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি বিষয়ে অসংখ্য গ্রন্থ ও ডকুমেন্টস, স্কুল-কলেজ-মাদরাসার স্মরণিকা ও বার্ষিকী, ৫০টি বিষয়ে পেপার ক্লিপিং, দৈনিক পত্রিকার কয়েকশো ঈদ ও নববর্ষ সংখ্যা, প্রায় ৩০০টি বিষয়ে কয়েক হাজার গ্রন্থ এখানে সংগৃহীত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

raj01

একান্তই ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে ব্যতিক্রমী এই সংগ্রহশালাটি প্রতিষ্ঠা করেন ড. মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ১৯৯৮ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাসাতেই লিফলেট, পোস্টার ও বিভিন্ন স্কুল-কলেজের স্মরণিকা ও বার্ষিকী সংগ্রহ শুরু করি। তখন ছাত্রছাত্রীদের পড়াতাম। তাদের বলতাম, তাদের স্কুল-কলেজে স্মরণিকা ও বার্ষিকী পেলে যেন নিয়ে এসে আমাকে দেওয়া হয়। বেশ সাড়া পেলাম, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাদের বন্ধুবান্ধবরাও লিফলেট, ব্যানার, পোস্টার, স্মরণিকা ও বইপত্র দিতে শুরু করলো। আমি প্রতিদিন রাজশাহীর সাহেব বাজারে পুরাতন বইয়ের দোকান থেকে কেজি দরে বইপত্র, ম্যাগাজিন কিনে নিয়ে আসতাম। এভাবে একবার দুই মণ বিচিত্রা পত্রিকা কিনে নিয়ে আসি।

jagonews24

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

ইতিহাস বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, স্থানীয় ইতিহাসের ওপর পিএইচডি করতে গিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম একসময়। প্রধান কারণ ছিল তথ্য সংকট। তথ্য সংগ্রহে নেমে দেখলাম কোথাও এক জায়গায় স্থানীয় ইতিহাসের ওপর তথ্য পাওয়া যায় না। এরপর ৯০‘র দশকে নেদারল্যান্ডসের একটি আর্কাইভসে গিয়ে দেখলাম সেখানে পোস্টার, লিফলেট, ব্যানার, ফেস্টুন ও সাময়িকী সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। সেখান থেকেই আমি দেশেও একটি হেরিটেজ আর্কাইভস গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিলাম। এমন সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালে নিজের বাসাতেই লিফলেট, ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টার সংগ্রহ করতে শুরু করে দিলাম। একটি দেশের সময়কে জানতে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অথচ বাংলাদেশের কোথাও এসব সংগ্রহ করে রাখা হয় না। তাই ব্যক্তিগত প্রচেষ্টাতেই এসব সংগ্রহ করা শুরু করি।

রাবির সাবেক এই শিক্ষক বলেন, আমি সংগ্রহ শুরু করার সময় ভেবেছি, বাংলাদেশের লাইব্রেরিতে যেসব সংগ্রহ করা হয় না, সেসব এই হেরিটেজ আর্কাইভসে সংগ্রহ করা হবে। বাংলাদেশের কোথাও কেউ লিফলেট, পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন, স্মরণি ও সাময়িকী সংগ্রহ করে না। একমাত্র হেরিটেজ আর্কাইভসেই তা সংগ্রহ করা হয়। এখানে বেশিরভাগ লিফলেট, ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন, স্মরণী ও সাময়িকী ৯০‘র দশকের হলেও ৭০’র দশকের অনেক লিফলেট, পোস্টার, ফেস্টুন, ব্যানার, স্মরণিকা ও সাময়িকী রয়েছে। কারণ এগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে।

jagonews24

বিজ্ঞাপন

‘দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসব উপকরণ সংগ্রহ করা হয়েছে। যখন যেখানে পেয়েছি ট্রাক ভর্তি করে কিনে এনেছি। অনেক সময় কিনে কুরিয়ারে নিয়ে আসা হয়েছে। তারপর বেছে হেরিটেজ আর্কাইভসে রাখা হয়েছে। প্রায় ৪০ থেকে ৪৫টি জেলায় আমার নিজস্ব নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। তাদের জেলার স্থানীয় ইতিহাসের ওপর কোনো লেখা ম্যাগাজিন বা বই-পুস্তক বের হলে তারা আমাদের দেন।’

তিনি বলেন, ২০০২ সাল থেকেই সংগ্রহের ক্যাটালগ করা হতো। ২০০৬ সালে বর্তমান ভবনের স্থানে জমি কিনে একতলা বিল্ডিং করে সেখানে সংগ্রহশালা গড়ে তুলি। এখানে বর্তমানে সাত ফিট বাই তিন ফিট বুক সেলফ রয়েছে ১৭৮টি। আরও কিছু আলমারি রয়েছে যাতে বইপুস্তক সংগ্রহ করে রাখা হয়।

jagonews24

বিজ্ঞাপন

তবে বর্তমানে হেরিটেজ আর্কাইভসটি একটি ট্রাস্টের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এখানে ছয়জন স্থায়ী কর্মী আছেন। হেরিটেজ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ড. মাহবুবর রহমান নিজেই।

এই ইতিহাস গবেষক আরও বলেন, তবে আর্কাইভসের নিজস্ব কোনো আয়ের উৎস নেই। আমার ও ব্যক্তি অনুদানে এটি চলে। নিজস্ব কোনো আয়ের উৎস করা গেলে আর্কাইভস নিয়ে কোনো চিন্তা থাকতো না। বর্তমানে স্থানীয় একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ডিজিটালাইজেশনের কাজ চলছে। অনেক লিফলেট, পোস্টার, ম্যাগাজিন ডিজিটালাইজেশন করা হয়েছে।

মনির হোসেন মাহিন/এমআরআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।