যে বটগাছ ঘিরে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, সেটিই আজ সীমানার বাইরে
কৈশরে ময়মনসিংহের ত্রিশালে যে বটবৃক্ষের নিচে ও ডালে বসে বাঁশি বাজাতেন কবি নজরুল, যে বৃক্ষ ঘিরে গড়ে ওঠে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। তবে আজ সেই বটবৃক্ষকই বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীরের বাইরে। কেন নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত বটবৃক্ষের প্রতি এমন অনাদর তার সদুত্তর দিতে পারছে না কেউ।
দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি ধরে রাখতে এদেশে নির্মিত হয়েছে বহু স্থাপনা। কিশোর নজরুল যে বটবৃক্ষের নিচে বাঁশি বাজাতেন সেই বটবৃক্ষটিকে কেন্দ্র করে ময়মনসিংহের ত্রিশালে শুকনি বিলের পাশে কবির নামে গড়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এটি নজরুলের নামে প্রতিষ্ঠিত দেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। তবে যে বৃক্ষটিকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম, প্রতিষ্ঠার ১৫ বছর পর সীমানা প্রাচীর নির্মাণের নামে সেই বটবৃক্ষকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে ছুঁড়ে ফেলেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
১০৭ বছর আগে ময়মনসিংহের ত্রিশালে এসেছিলেন কিশোর দুখু মিয়া। দুখু মিয়ার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে দারোগা রফিজউল্লাহ তাকে ভর্তি করান দরিরামপুর ইংরেজি হাইস্কুলে (বর্তমান নজরুল একাডেমি)। প্রথমে কাজীর শিমলা দারোগা বাড়িতে থাকলেও যাতায়াতের কষ্ট লাঘবের জন্য দারোগা সাহেব দুখু মিয়াকে ত্রিশালের নামাপাড়ায় জায়গীর রাখেন। সেই দুখু মিয়া পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন বাঙালির বিদ্রোহী কবি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
স্বাধীনচেতা নজরুল ইসলাম মাঝে মধ্যে স্কুল বাদ দিয়ে নামাপাড়া শুকলি বিলের পাশে বটবৃক্ষে চড়ে বাঁশি বাজাতেন। যে বটগাছে বসে দুখু মিয়া বাঁশি বাজাতেন সেই গাছটিই এখন নজরুল বটবৃক্ষ নামে পরিচিত।
স্মৃতি ধরে রাখতে বটবৃক্ষকে কেন্দ্র করেই নজরুলপ্রেমীরা দাবি করেন একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। সেই বটগাছের পাশেই শুকনি বিলে ৯৩ বছর পর ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠা পায় কবির নামে বিশ্ববিদ্যালয়। কবি নেই, কিন্তু বটগাছটি আজও কালের সাক্ষী হয়েই দাঁড়িয়ে আছে।
বর্তমান সরকারের সামগ্রিক উন্নয়নের অংশ হিসেবে ১৫ বছরে পদার্পণ করা বিশ্ববিদ্যালয়টি পিছিয়ে না থাকলেও অনাদর অবহেলায় রয়েছে বটগাছটি। এতে নজরুলপ্রেমীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারিতায় এমন কাণ্ড ঘটেছে বলে অভিযোগ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।
শুরুতে মাত্র ১৫ একর জমির ওপর নির্মিত হয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। শুরু থেকে বটবৃক্ষের পাশ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক থাকলেও আস্তে আস্তে ভবন নির্মাণের নামে বৃক্ষটিকে আড়াল করা হয়। সর্বশেষ ২০২১ সালে আংশিক সীমানা প্রাচীর নির্মাণের সময় বটগাছটিকে বাইরে রেখেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীর গড়ে তোলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে নজরুলের স্মৃতিধন্য বৃক্ষটি ক্যাম্পাসের বাইরে ও ভবনের আড়ালে থেকে যায়। এ গাছের নিচে এখন চায়ের দোকান আর টং দোকানের বাহারি সমাহার, নেই কোনো পরিচর্যা।
৭০’র দশকে তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার ম্যাজিস্ট্রেট পি এ নাজির নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত বটগাছের গুরুত্ব অনুভব করে প্রথমবারের মতো এর চারপাশে পাকা বেদী করেন। এরপর আর এই বটবৃক্ষের দিকে ফিরে তাকায়নি কেউ। ত্রিশালে নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত সব স্থাপনা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে রক্ষণাবেক্ষণ করা হলেও বটগাছটি বরাবরই নিগৃহীত।
নজরুল গবেষক এবং বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজের উপ-পরিচালক রাশেদুল আনাম বলেন, কালের পরিক্রমায় নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত সব জায়গার পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংস্কার হলেও একমাত্র জীবন্ত কিংবদন্তী হিসেবে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে বটগাছটি। যেহেতু নজরুলের নামে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত বটগাছটি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা।
এ ব্যাপারে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক হাফিজুর রহমান জানান, প্রথম দিকে আমরা জানতাম বটবৃক্ষের জমিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। তাই অধিগ্রহণে জটিলতা ছিল। তবে সম্প্রতি আমরা জানতে পারি এই জমিটি ব্যক্তি মালিকানাধীন। নজরুলের স্মৃতিকে ধরে রাখতে বটবৃক্ষটি সংরক্ষণ প্রয়োজন। আমরা পরবর্তী পরিকল্পনায় এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।
যে বটগাছকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন হলেও বটগাছটি সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যা জাতীয় কবির স্মৃতিকে অবমাননার সমতুল্য।
নজরুলপ্রেমীদের এমন অভিযোগের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, কিছুদিন হলো আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছি। এর আগে কখনো এ ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি বলে জেনেছি। আমাদের জাতীয় কবির স্মৃতি ধরে রাখতে দ্রুত সময়ের মধ্যে নজরুল বটবৃক্ষকে বিশ্বদ্যিালয়ের আওতায় নিয়ে আসার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।
এফএ/জেআইএম