২ বছর আগের পরীক্ষা এখনো হয়নি, দীর্ঘ সেশনজটে ৭ কলেজ শিক্ষার্থীরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তির পর থেকে সঠিক সময়ে পরীক্ষা না নেয়ায় ভয়াবহ সেশনজটে পড়েছিলেন রাজধানীর সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। সেই সঙ্গে ফলাফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রিতা, গণহারে ফেলসহ নানা জটিলতা তো রয়েছেই। প্রশাসনের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় সেশনজটসহ অন্যান্য সমস্যা কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পারলেও করোনা মহামারিতে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বর্তমানে শিক্ষা কার্যক্রমে অনেকটাই স্থবির। কিছু প্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাস চলমান থাকলেও তাতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম। যার ফলে আবারও সেই আগের রূপেই ফিরতে শুরু করেছে সাত কলেজ। এমন অবস্থায় ভবিষ্যৎ আর ভয়াবহ সেশনজটের চিন্তায় দুঃসহ সময় পার করছে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা।
জানা গেছে, সাত কলেজের স্নাতোকোত্তর শেষ পর্ব ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষা নিয়মানুযায়ী ২০১৮ সালে, স্নাতোকোত্তর প্রিলিমিনারি ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষা নিয়মানুযায়ী ২০১৭ সালে এবং ডিগ্রি ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা নিয়মানুযায়ী ২০১৮ সালে হওয়ার কথা থাকলেও এখনো অনুষ্ঠিত হয়নি।
এসব কলেজের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, পরীক্ষা না হওয়ায় দীর্ঘদিনেও পড়ালেখার ইতি টানতে পারছেন না তারা। যার ফলে অনিশ্চয়তা, শঙ্কা আর উৎকণ্ঠায় দিন কাটাতে হচ্ছে।
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী রকিবুল হাসান বলেন, ‘চলমান পরিস্থিতিতে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেশনজট কাটিয়ে উঠতে নানা পরিকল্পনা নিলেও আমাদের জন্য কোনো পরিকল্পনাই নেয়া হয়নি। আগে থেকে সেশনজটে থাকায় এখন আরও বেড়েছে। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানাচ্ছি।’
এ ছাড়াও ইতোমধ্যেই সেশনজটের রয়েছে স্নাতক ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরাও। শিক্ষার্থীরা জানান, কাগজে-কলমে গত বছরের জুন মাসে স্নাতক শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত তৃতীয় বর্ষের সবগুলো বিভাগের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফলই প্রকাশিত হয়নি। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর দীর্ঘসময় অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত ২৫টি বিভাগের মধ্যে মাত্র চারটি বিভাগের ফলাফলই প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও প্রাণিবিদ্যা ও গণিত বিভাগের তৃতীয় বর্ষের চূড়ান্ত ব্যবহারিক ও ভাইবা পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয়নি এখননো। তবে ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে কলেজ থেকে সরবরাহকৃত আইডি কার্ডের মেয়াদ। স্নাতক সম্পন্ন করতে চার বছর মেয়াদকাল শেষ হয়ে ছাত্রত্ব শেষ হলেও এখনো তৃতীয় বর্ষের গণ্ডিই পেরুতে পারেননি এসব শিক্ষার্থী।
অথচ এই একই সেশনের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চতুর্থ বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করছেন। এমন অবস্থায় দীর্ঘ সেশনজট আর এক বছরের বেশি সময় পিছিয়ে পড়ার পেছনে সাত কলেজের প্রশাসনের অবহেলাপূর্ণ আচরণে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা কলেজের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী মুনতাসির ফাহাদ বলেন, ‘এখন আমাদের স্নাতক শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনো আমরা তৃতীয় বর্ষের গণ্ডিই পেরোতে পারিনি। এ ছাড়াও আনুষ্ঠানিকভাবে চতুর্থ বর্ষের ক্লাসও শুরু হয়নি। ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা শঙ্কিত।’
এ ছাড়াও চূড়ান্ত পরীক্ষায় সময় ও মানবণ্টনে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন- এমন অভিযোগও জানান অনেক শিক্ষার্থী।
সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ বলেন, ‘সাত কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার মানবণ্টন ও সময়সীমাতে চরম বৈষম্যের শিকার। ২০১৭-১৮ এবং ১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষার মানবণ্টনে ও সময়সীমাতে পরিবর্তন এসেছে। পূর্বে পরীক্ষায় ৫০ নম্বরের জন্য সময় ছিল তিন ঘণ্টা। বর্তমানে সেটা পরিবর্তন করে তিন ঘণ্টার মধ্যে ৭৫ নম্বরের পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাবি কর্তৃপক্ষ। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে নিজস্ব মানবণ্টন ও সময়সীমা পূর্বাবস্থায় বহাল রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থেকে এমন বৈষম্যমূলক নীতি সত্যিই শিক্ষার্থীদের জন্য চরম হতাশাজনক ও বৈষম্যমূলক আচরণ।’
এ ছাড়াও সেশনজট, পর্যাপ্ত ক্লাস না হওয়াসহ নানা সীমাবদ্ধতা থাকার পরও অতিরিক্ত সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর ফলে শ্রেণিকক্ষে স্থান সংকুলান না হওয়ায় পাঠদানেও পূর্ণভাবে মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয় না বলে অভিযোগ করেন একই প্রতিষ্ঠানের গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী শোয়াইব সরকার সৌরভ।
তিনি বলেন, ‘প্রতিটি বিভাগেই ধারণক্ষমতার অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি নেয়া হয়। যার ফলে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বসার জায়গাও নেই। অনেককেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। শুনেছি, কলেজ প্রশাসন নাকি অভ্যন্তরীণ খরচ মেটাতে এতো শিক্ষার্থী ভর্তি করে। আবার এ বছর আরও সিট বাড়ানো হয়েছে।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ও সরকারি সাত কলেজের সমন্বয়ক অধ্যাপক সেলিম উল্লাহ খোন্দকার বলেন, ‘অধিভুক্তির পর থেকে নানা জটিলতার পরও দীর্ঘ প্রচেষ্টায় সেশনজট নিরসন সম্ভব হয়েছিল। সবকিছুই একটা নিয়মের মধ্যে আনতে আমরা সক্ষম হয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে করোনার কারণে সার্বিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে আমরা এখনো পরিকল্পনা করে রেখেছি। লকডাউন শিথিল হলে যে কোনো মূল্যেই হোক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত পরীক্ষাসহ সার্বিক কার্যক্রম সম্পন্ন করবো।’
তৃতীয় বর্ষের বাকি থাকা ব্যবহারিক পরীক্ষার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখনো অনলাইন পরীক্ষার কথা আমরা চিন্তা করছি না। পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হলেই দ্রুত পরীক্ষাগুলো সম্পন্ন করা হবে।’
এ ছাড়াও বর্তমান পরিস্থিতিতে সার্বিক বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে আগামী ৫ আগস্ট সাত কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে বৈঠকের করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) ও সাত কলেজের প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল।
নাহিদ হাসান/ইএ/এমকেএইচ